মধুকাল

 

মধুকাল

রাজ চক্রবর্তী


 

জানলার বাইরে পাতাবাহার গাছটায় একটা ফিঙে রোজ সকালে এসে বসে। সুকান্ত চোখ খুলেই সেটা দেখতে পায়। অলস চাহনিতে তাকিয়ে থাকে দু’জন একে অপরের দিকে। ফাঁকা অগোছালো ঘরটায় প্রাণের আর কোন স্পন্দন নেই। সুকান্ত জানে তাকে তাড়া দেওয়ারও কেউ নেই। খোলা জানলাটা দিয়ে সামনে তাকালেই ছোট্ট উঠোনবাড়ির বাউন্ডারি পাঁচিলের ওপাশে সরু পিচের রাস্তাটা চলে গেছে আপন খেয়ালে। রাস্তার ওপারে কিছুটা ফাঁকা জায়গার পরেই মাঝারি মাপের একটা পুকুর। আগে সকাল হলেই পাড়ার কচিকাঁচার দল দাপিয়ে বেড়াত পুকুরের জলে। এখন বেশিরভাগটাই কচুরিপানায় ভর্তি।

সুকান্ত আড় চোখে দেওয়ালের ঘড়িটার দিকে একবার তাকায়। প্রায় আটটা বাজতে চলল। এবার উঠতেই হয়। এরপর টাইম কলের জল চলে গেলে সেই বারোটার আগে আর আসবে না। ফিঙেটা তার লম্বা ল্যাজ দুলিয়ে বার দু’য়েক শিস দিয়ে উড়ে গেল দক্ষিণে ঘোষেদের বাগানের দিকে। যেন বলে গেল, কাল আবার দেখা হবে।

সকালে এক কাপ চা না খেলে দিনটা ঠিক শুরু হতে চায় না সুকান্তর। কিন্তু নিজের আলসেমিতে সেটা প্রায় দিনই হয়ে ওঠে না। মোড়ের মাথায় নিকুঞ্জদার চায়ের দোকান ভরসা। এই সময়টা আবার বাজার ফেরত বাবুদের ভিড়। তার সাথে আছে আশেপাশের যত অকেজো বুড়োর দল।

সেদিন বিকাশ জেঠামশাই পায়ের উপর পা নাচাতে নাচাতে সুকান্তর দিকে আড় চোখে চেয়ে পাশের সুকুমার বাবুকে খোঁচা দিয়ে বললেন, বাপ ঠাকুরদার পয়সায় আর কদিন চলবে সুকু। সারা জীবন কিছুই তো করলি না বাপ! সুকান্ত জানে কথাটা তাকেই বলা হল, নামের মিল থাকায় সুকুমার বাবুকে শিখন্ডী বানিয়ে মাঝখানে রাখলেন বিকাশ জেঠু। না হলে সুকুমার বাবু দিব্য এত বছর বাজারে চালের ব্যবসা করে আসছেন। এখন ছেলের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়ে ঝাড়া হাত পা।

উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেল সুকান্ত। নিকুঞ্জদা ইশারায় চুপ থাকতে বললে বলে সে যাত্রা বিকাশ জেঠু পার পেয়ে গেল। আরও একদিন কি যেন একটা কথায় মুখের উপর উত্তর দিতে গিয়েছিল সে, সদানন্দ গায়েন সুরুৎ করে চায়ের গ্লাসে টান দিয়ে বললেন, সুকান্ত আবার বিদ্রোহী হলে কবে?

নাহ! তারপর থেকে ওই সময়টা সে আর চায়ের দোকানে যায় না। সে বাপ ঠাকুরদার পয়সায় খায় তাতে কার কি? সে কি কারো কাছে হাত পাততে গেছে কোনদিন? একটা পেট চালাতে আবার চাকরি করতে হয় নাকি?

বিছানা ছেড়ে উঠে কলতলায় গিয়ে জলের বালতিগুলো ভরে রাখে চটপট। তারপর উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা শুকনো পাতা ঝাঁট দিয়ে একপাশে করে কোণার ওই যে নিম গাছটা, ওটা পুঁতেছিলেন মা। আর এপাশের আম গাছটা বাবার হাতের। এদের পাতা ডাই করে জ্বালিয়ে দিতে কেমন মায়া লাগে সুকান্তর।

সকালের ভিড়টা কেটে গেলে নিকুঞ্জদার দোকানে গিয়ে বসে সুকান্ত। টালির চাল আর কাঠের উনোনের গন্ধ ভরে নেয় ফুসফুসে। পিছনের অশ্বত্থ গাছে কয়েকটা হনুমান থাকেসুকান্ত এলেই তারা নেমে আসে সামনে। এক প্যাকেট বিস্কুট আর গোটা সাতেক কলা তাদের জন্য ধরা থাকে রোজ। এর দাম নিকুঞ্জদাকে কখনও দিতে পারে, কখনও পারে না।

এই পৃথিবীতে একমাত্র নিকুঞ্জদাই বোধহয় একটু ভালোবাসে সুকান্তকে। তার নানান আবদার মেনে নেয় হাসিমুখে। বাকি আত্মীয় স্বজনদের খবর সুকান্ত রাখে না। তারাও কেউ আগ বাড়িয়ে সুকান্তর খবর নেয় না কোনদিন। তাতে ভারি বয়ে গেল! সে একা একাই বেশ আছে!

আজ চায়ের দোকানে ঢুকতেই নিকুঞ্জদা তেড়ে এল, —এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাস কেন? যে শুয়ে থাকে তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে, শুনিসনি?

সুকান্ত বয়াম থেকে একটা টোস্ট বিস্কুট বের করে মুখে দিতে গিয়েও থেমে গেল।

—জানি গো, অনেক বাকি পড়েছে তোমার দোকানে। দিয়ে দেব। সত্যি বলছি।

—বাকি! তুই আমাকে টাকা দেখাচ্ছিস? আরও চটে উঠল নিকুঞ্জদা।

দোনোমোনো করে বিস্কুটটা দাঁতে কেটেই ফেলল সুকান্ত। নিকুঞ্জদার রাগ জল হতে পাঁচ মিনিটও লাগবে না, সে জানে।

—তুমি তবে এত ক্ষেপেছ কেন আজ? বিকাশ বুড়ো আজ আবার ঝামেলা করেছে নাকি?

—তোর নজর শুধু বিকাশদার দিকে। তুই দেখতে পারিস না বলে কি লোকটা খারাপ! একটা কথা শুনে রাখ স্পষ্ট, ওদের টাকাতেই আমার দোকান চলে। ওরা দু’বেলা এসে বসে বলেই ওই বিনি পয়সায় টোস্ট তুমি গিলতে পারছ। যত্তসব! নিকুঞ্জদা সামনে জমে থাকা খালি চায়ের গ্লাসগুলো তুলে নিয়ে ধুতে চলে গেল।

বিনি পয়সার বিস্কুট! কানের পাশের শিরা দপদপ করে উঠল সুকান্তর। ছুড়ে ফেলে দিতে গেল বিস্টুটের অর্ধেকটা। রে রে করে উঠল নিকুঞ্জদা, —এই খবরদার! বিস্কুটটা ফেলেছিস কি আর বাপের জন্মে এ দোকানে পা দিতে দেব না।

আজ এখানে ঠিক জমবে না, বুঝে গেছে সুকান্ত। আধ খাওয়া বিস্কুটটা মুখে ফেলে দিল সে। বিস্কুটের লোভে যে কুকুরটা এতক্ষণ সুকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে ল্যাজ নাড়ছিল, সেও একরাশ হতাশা নিয়ে থেবড়ে বসে বসল সামনে।

—কিছু একটা কর বুঝলি! বাপের জমানো টাকার সুদে আর কদিন চালাবি? ব্যাঙ্কের সুদও রোজ যে হারে কমছে! রাজার ধনও এক সময় শেষ হয়, তোর বাপে আর কত টাকা রেখে গেছে? জোয়ান মদ্দ ছেলে। শুধু শুধু...

—চলি আমি! বাড়িতে কাজ আছে। উত্তরের অপেক্ষা না করে সুকান্ত দোকানের দাওয়া থেকে নেমে এল।

নিকুঞ্জদার মেজাজকেও দোষ দেওয়া যায় না। ছেলেটা শহরে গিয়ে নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে আর এমুখো হল না। বউটা দু’বছর হল মরেছে তিনদিনের জ্বরে। বাপ মেয়ে মিলে কোনমতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জীবনের ঘানি।

সারাটা রাস্তা নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে এল সুকান্ত। সক্কালবেলা মাথাটা অহেতুক গরম হয়ে গেল। নিকুঞ্জদাকে সে কিছু বলতে পারে না। তা নাহলে যে বংশ তুলে, বাপ তুলে যে এতগুলো কথা বলল তাকে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র সুকান্ত মুকুজ্জে নয়।

বাড়ির গেটে পৌছেই বুড়িকে দেখতে পেল সুকান্তঅনেক দিন বাঁচবে মেয়েটা! ওর কথাই তো ভাবতে ভাবতে আসছিল সেনিকুঞ্জদার ছোট মেয়ে।

—তুই এসেছিস! বাঁচালি। চট করে স্টোভটা জ্বালিয়ে একটু ভাতে-ভাত বসিয়ে দে দেখি।

—কোথাও যাবে না কি?

—নাহ! কোথায় আর যাব! সকাল থেকে জীবন আকাশের মুখ ভার। মেঘের ঘনঘটা। স্নান খাওয়া সেরে একটা লম্বা ঘুম দেব।

—মুখ ভার আকাশের! মেঘের ঘনঘটা! কোই গো সুকুদা? দিব্যি তো রোদ ঝলমলে দিন।

—ও তুই বুঝবি না। যা বললুম, কর দেখি চটপট!

মা মরা মেয়েটাকে তার ঘাড়ে চাপাতে চায় নিকুঞ্জদা। সেটা গত বছর থেকেই আঁচ করতে পারছে সুকান্ত। সে একেবারে পাত্তা দেয় না। কোন বংশের ছেলে সে! একটা চা-ওয়ালার মেয়েকে ঘরে তুলতে তার বয়েই গেছে। সেই কারণেও রাগ হতে পারে নিকুঞ্জদার

বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিল সুকান্ত। হাত বাড়িয়ে মাথার দিকের জানলাটা খুলে দিতেই গনগনে রোদের ঝাঁঝ ঢুকে এল ঘরে। চড়া সূর্যের আলোয় চোখ বুজে ফেলল সে। 

—চা খাবে সুকুদা? পাশের রান্নাঘর থেকেই প্রশ্নটা ছুড়ে দিল বুড়ি। ওর ভালো নামটা যেন কি? মনে করতে পারল না সুকান্ত।

—তোর বাবা যা চা খাওয়াল সকালে! ওতেই জিভ পুরে গেছে। তুই বাদ দে।

বুড়ির চুড়ির আওয়াজ আসছে বাইরে থেকে। বেশ সুরেলা একটা রিনিঝিনি শব্দ। চোখ বুজে শুনছিল সুকান্ত। মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মায়ের বড় সাধ ছিল ছেলের বউ দেখে যাবে। নাতি নাতনিকে রোদে শুইয়ে তেল মালিশ করবে।

বাবা হেসে বলতেন, —এত কিছু থাকতে রোদে শুইয়ে তেল মালিশ! বলিহারি তোমার শখ!

মা বড়বড় চোখে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা হাত গালে ঠেকাতেন, —সেকি! তোমার মা ঠাকুমাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর, তোমাকেও তাঁরা তাই করেছেন। এতে ভিটামিন ডি এর ঘাঁটতি পুরণ হয়। তুমি কিচ্ছু জান না!

কথাগুলো অনেক দিন পর আবার মনে পড়ে গেল সুকান্তর। 

—আমি এবার যাই?

বুড়ির ডাকে চটকা ভাঙলো সুকান্তর। চোখ মেলে তাকাল বুড়ির দিকে। গোল পান পাতার মতন মুখ। এলো চুল হালকা হাওয়ায় উড়ছে ঘরের গরম বাতাসে। তাদের কয়েক গাছা বুড়ির ফাঁকা সীমন্ত ঢেকে দিতে তৎপর। পরনের শাড়ির আচলটা কাঁধের শেষ প্রান্তে আটকে আছে আলগা হয়ে। ঘোর লাগছে সুকান্তর চোখে। প্রথম রিপু টুসকি দিয়ে যায় অশান্ত মনের দড়জায়

—কিছু বলবে? বুড়ির কাজল কালো চোখ সরাসরি সুকান্তর চোখে।

মেয়েটা যে কি চায় ঠিক বোঝেনা সুকান্ত। একেক সময় মায়ের মতন যেচে এসে ঘরের কাজ করে দিয়ে যায়। বিছানার চাদর পালটায়, রান্না চাপায়, কলতালার বালতি ভরে জলে। আবার কখনও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সুকান্তর দিকে। সে চোখের ভাষা সুকান্ত জানে না।

কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে সুকান্তর চোখ জ্বালা করে ওঠে। সে প্রসঙ্গ পালটাতে বলে, —আজ কলেজ নেই তোর? যাবি না নাকি?

—নাহ্! একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে বুড়ির বুক ঠেলে।

—কেন রে?

—বাবার শরীরটা ভালো নেই দু’দিন ধরে। আজ বললাম দোকানে যেতে না, কে শোনে!

নিকুঞ্জদার শরীর খারাপ! কই দেখে তো মনে হয়নি সুকান্তর। গালের তিনদিনের বাসি দাড়িতে হাত বুলিয়ে সুকান্ত বলল, —তেমন তো মনে হল না রে! আমার সাথে এক হাত হয়ে গেল একটু  আগেই।

—সে লোককে কোনদিন বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝা গেছে সুকুদা, যে আজ তুমি বুঝবে!

কথাটা ঠিক। নিকুঞ্জদাকে দেখে তার ভিতরের অবস্থা বোঝা যায় না। ছেলে যখন বৌ নিয়ে চলে গেল কেমন শান্ত ছিল নিকুঞ্জদা! বৌ’টা মরল হঠাৎ করেই। একই রকম নির্লিপ্ত থেকেছে তার কঠিন মন আর শরীর। শ্মশান থেকে ফিরেই সকলকে অবাক করে দিয়ে বিকেলে দোকান খুলে উনুনে আগুন দিল।

—হুম! তুই যা তাহলে। আজ না এলেই তো পারতিস! নির্লিপ্ত স্বরে বলল সুকান্ত।

বুড়ি পিছন ফিরল। —বেশি দেরি করো না। গরম গরম খেয়ে নিও। আর খেয়েই শুয়ে পড়ো না। খুব বাজে অভ্যাস তোমার। আমি আসি। বুড়ির গলার স্বর ক্রমশ কাছে থেকে দূরে সরে গেল। সুকান্ত সেই শব্দের পথে চেয়ে রইল অপলক।

 

দু’দিন পর অযাচিতভাবেই খবরটা এল। সকালে ঘরের নিত্যকার টুকিটাকি কাজ সেরে নিকুঞ্জদার দোকানের কাছে গিয়েই অবাক হয়ে গেল সুকান্ত। ছোটখাট একটা ভিড় সেখানে। মৃদু গুঞ্জন ভেসে এসে তাকে ছুয়ে গেল। বুড়ি বলছিল বাবার শরীরটা খারাপ। কিছু হল নাকি? ভিড় ঠেলে সামনে এল সুকান্ত। একপাশে রাখা সরু বেঞ্চটার উপর বসে আছে নিকুঞ্জদাচোখ বন্ধ।

কি হল? পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পার্থকে ভ্রু তুলে ইশারায় জানতে চাইল সুকান্ত। পার্থ মাথা নামিয়ে মুখটা কাছে এনে আস্তে আস্তে বলল, —পিন্টু, মারা গেছে।

পিন্টু নিকুঞ্জদার ছেলে। বছর সাতেক আগে বাড়ি ছেড়েছে। প্রায় কোন সম্পর্কই আর রাখে না। মায়ের শ্রাদ্ধ করতে এসেছিল শেষ বার দু’বছর আগে। পিন্টুর নামটাই সবাই ভুলতে বসেছে এই অঞ্চলে। নিকুঞ্জদাকে সেই ছেলের জন্য পাথরের মতন বসে থাকতে দেখে অবাকই হল সুকান্ত।

শহরে কোন এক কারখানায় কাজ করতে গিয়ে সেখানকারই একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে এনে তুলেছিল পিন্টু। নিকুঞ্জদা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সেই মেয়ে এক বছরও ঘর করতে পারেনি। রোজ অশান্তি। সুকান্ত শুনেছে যাওয়ার আগে বাপের গায়ে নাকি হাতও তুলেছিল পিন্টু। সেই ছেলের জন্য আবার শোক!

ক্লান্ত চোখ মেলে চাইতেই সুকান্তকে দেখতে পেল নিকুঞ্জদা। হাতের ইশারায় পাশে বসতে বলল। আশেপাশের ভিড়টা একটু পাতলা হয়েছে ততক্ষণে। অনুসন্ধিৎসু মুখগুলো তেমন কোন রসদ না পেয়ে হতোদ্যম হয়ে যে যার পথ দেখতে শুরু করেছে।

একটা সরু কম্পমান হাত উঠে এল সুকান্তর কাঁধে। কয়েক মুহূর্ত থেমে নিকুঞ্জদা বলল, —শুনেছ বোধহয়? পিন্টুটা চলে গেল।

—হুম! অস্ফুটে উত্তর দিল সুকান্ত।

—একা হয়ে গেলাম সুকান্ত।

সুকান্তর চোখে বিষ্ময়। যে ছেলে বাপ বেঁচে আছে কি না কোনদিন খবর নেয় না, সে মরে গিয়ে নিকুঞ্জদাকে একা করে দিয়ে গেল কি করে?

নিকুঞ্জদা নিজের মনে বলে চলেছে, —ভেবেছিলাম দোকানটা পাকা করে পিন্টুকে ডেকে নেব। সংসারে অশান্তি তো থাকবেই। আমি আর কদিন। মেয়েটার একটা হিল্লে করে দিতে পারলেই, আমার ছুটি। কিন্তু তা আর হল না।

—কি করে হল? অনিচ্ছা স্বত্তেও প্রশ্নটা করল সুকান্ত।

নিকুঞ্জাদার পরিবর্তে পাশ থেকে একজন অবজ্ঞাভরে উত্তর দিল, —কাল রাতে ঠেকে বসে ভরপেট গিলেছিল। ভোর রাত থেকে বমি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই শেষ।

সুকান্ত তাকিয়ে ছিল দূরের দিকে। কাঁচা রাস্তাটা সোজা গিয়ে ডাইনে বাঁক নিয়েছে। এখনও লাইট পোস্ট বসেনি এদিকটায়। সন্ধ্যার পর টর্চ আর মোবাইলের আলোই ভরসা। বৃষ্টির দিনে সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হয়। সূর্য এখন মধ্য গগনে। রোদের তেজে চোখ জ্বালা করছে। হঠাৎ বুড়ির কথা মনে পড়ল সুকান্তর। সে জানে? কোথায় বুড়ি?

প্রশ্নটা মনে আসতেই নিকুঞ্জদার দিকে ঘুরে বসল সুকান্ত। তখনও দেখতে পেল উল্টোদিকের রাস্তা দিয়ে বুড়ি হেঁটে আসছে ধীর পায়ে। চোখেমুখে ক্লান্তি। একটু যেন পা টেনে হাঁটছে।

নিকুঞ্জদারও চোখে পড়েছে। গম্ভীর মুখে বলল, —এটাকে নিয়ে যে কি করি? সকাল থেকে খবরটা পেয়ে ইস্তক কেঁদেই চলেছে। কার হাতে ওকে দিয়ে যাই?

মুখটা তেঁতো হয়ে গেল সুকান্তর। এই সময়ও নিকুঞ্জদা বারবার তাকে বুড়ির কথা শোনাচ্ছে কেন? আচ্ছা পাবলিক তো! তাকে শুনিয়ে কি লাভ? সে কি করতে পারে? বুড়ি তার বাড়িতে মাঝে মাঝে যায়একটু আধটু রেধে বেড়ে দেয়। বদলে সেও তো বুড়িকে কলেজের পড়া দেখিয়ে দেয়। কাজেই শোধবোধ।

বুড়ি বাবার সামনে এসে পায়ের কাছে বসে পড়ল। মাথাটা আলতো করে রাখল বাবার কোলে। সুকান্ত ভাবছিল উঠে যাবে। বাপ-মেয়ে একটু একা থাক। কাঁদুক নিজেদের মত করে। যদিও কান্নার কি আছে কে জানে! একটা পাঁড় মাতাল বখাটে ছেলের জন্য... যত্তসব নাটক!

সুকান্ত উঠতে যেতেই নিকুঞ্জদা ওর হাতটা চেপে ধরল। সুকান্তর ইচ্ছা করছিল এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে চলে যেতে। এখনও লোকটা তাকেই টার্গেট করে রেখেছে! না হয় একটু আধটু বিস্টুট-টিস্কুট খায় মাঝে মাঝে। কিন্তু তাই বলে এত গায়ে পড়া কেন বাপু?

সুকান্তর হাতের পেশি শক্ত হয়ে ওঠে। বুঝতে পেরেই বোধহয় আঙুলের চাপ আলতো করে নিকুঞ্জদা। তারপর মাথা নামিয়ে বলে, —চললে সুকান্ত? আচ্ছা যাও। কড়া ধাতের মানুষটার গলাটা আজ কেমন যেন মিইয়ে রয়েছে।

 

হপ্তাখানেক সুকান্ত আর দোকানের দিকে যায়নি। কেন যায়নি তা জানেনা সে নিজেও। নিকুঞ্জদার প্রতি রাগ, ঘৃণা না নিজের মনের জড়তা কোনটা তাকে বিরত রেখেছে সেটাও সে ভালো বোঝেনা। বুড়িও এর মধ্যে আর আসেনি তার কাছে। ছেলেটার সাথে তেমন সখ্যতা ছিল না সুকান্তর, কিন্তু তাও পিন্টুর মরে যাওয়াটা কেমন হঠাৎ থমকে দিল সুকান্তর জীবনটাকে। একটা একটানা অভ্যাসে যেন ভাটার টান এল।

সুকান্ত মাঝে মাঝে ঘরে তালা ঝুলিয়ে এদিক সেদিক চলে যায়। এটা তার অনেকদিনের অভ্যাস। মন একটু উচাটন হলেই সে পালাতে চায় এই চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে। মন খারাপ হলেই মায়ের উপর খুব অভিমান হয়। তখন নিজের মনে ঘুরে আসে কোন এক অজানা জায়গা থেকে। একা একা ঘুরে বেড়ায় সমুদ্রের ঢেউয়ের আলতো ছোঁওয়ায় পা ডুবিয়ে। আবার কখনও বনানীর শান্ত কোলে কান পেতে অচেনা কোন পাখির সুমধুর ডাকে দূরের স্বপ্নের দেশ থেকে ফিরে আসে।

মা চলে যাওয়ার পর একমাস কাটিয়ে এসেছিল বেনারসের ঘাটে ঘাটে। কিসের খোঁজে কে জানে? কিছু না খোঁজার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে সেটা বোঝে সুকান্ত। ফাঁকা মন নিয়ে অনন্তের দিকে চেয়ে থাকার যে সুখ, তার সবটুক রস নিংড়ে নিতেই সে হারিয়ে যায় মাঝেমাঝে। বন্ধনহীন এই জীবন তাই এত প্রিয় তার।   

 এই কদিনে আবার সেই ভাবটা ফিরে এসেছে সুকান্তর মধ্যে। গুমোট ভাবটা যেন ক্রমশ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। মুক্ত বাতাস চাই। আজ সকালেই নিজের ছোট ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়েছে। কোনমতে একটু খিচুড়ি ফুটিয়েছে সকালে পাতাবাহারের ডালে তার ফিঙে বন্ধুর থকে বিদায়ও নিয়ে নিয়েছে। কয়েকটা দিন একটু ঘুরে আসি। পাখিটা কি তার ভাষা বোঝে? হয়ত বোঝে! তাইকি তার মুখটা একটু করুণ হয়ে গিয়েছিল? উড়ে যাওয়ার আগে অন্য দিনের মতন বলেও গেল না যে!

সুকান্ত এবার কোথায় যাবে ঠিক করেনি। প্রথমে হাওড়া স্টেশন। তারপর দেখা যাবে। মায়ের ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সুকান্ত। অনেকদিন মাকে দেখা হয়নি তেমনভাবে। ছবিটার গায়ে জমে থাকা ধুলোর হালকা আস্তরণ মুছে দিল পরম যত্নে। হারিয়ে যাওয়ার আগে মাকে ভীষণ মনে পড়ে তার। মা হঠাৎ চলে যাওয়ায় তার অভিমান হয়েছিল খুবসেই অভিমানেই সে ঘর ছাড়ে বারেবারে।

মা হাসছেন ছবিতে। সেদিকে তাকিয়ে সুকান্ত নিজের মনেই বলল, একদিন এমনি গিয়ে আর ফরে আসব না ঠিক দেখ। তখন থেকো তোমার নিমগাছ আর বাবার আমগাছ নিয়ে। আমায় একা ফেলে যাওয়ার শাস্তি।

সদর দড়জা খুলেই থমকে গেল সুকান্ত। সামনে দাঁড়িয়ে বুড়ি। মনটা বিষিয়ে গেল সুকান্তর।

হাতের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে বুড়ি বলল, —কোথাও যাচ্ছ সুকুদা?

—হ্যাঁ! অবহেলায় উত্তর দিল সুকান্ত।

—কোথায়? বুড়ির চোখে বিষ্ময়।

—তোর কি?

উত্তর না দিয়ে ভিতরে ঢুকে এল বুড়ি। নিজের অজান্তেই যেন পথ ছেড়ে দিল সুকান্ত।

—আজ উঠোনটাও তো ঝাঁট দাওনি দেখছি!

—না দিইনি। বেশ করেছি।

—বাবা কি রাগ। ওদিকে বাবা, এদিকে তুমি। আমি কোথায় যাই?

সুকান্তর দেরি হয়ে যাচ্ছে। হাতের ব্যাগটা কাঁধে ফেলে বলল, —আমি এবার যাব বুড়ি।

বুড়ি ফিরে এসে সুকান্তর মুখোমুখি দাঁড়াল। সেই পান পাতার মতন মুখ, দিঘল আঁখি। খোলা চুল আদুরে খেলা করে চলেছে তার গালে গলায় ঘাড়ে।

—একটু জল খাওয়াও না সুকুদা! যাওয়ার আগে পুন্যি করে যাও। বুড়ি আদুরে গলায় বলল।

বিরক্ত হয়ে আবার দড়জার তালা খুলল সুকান্ত। ঘরে টেবিলে উপর জলের বোতলটা রয়েছে। মায়ের ছবিটায় চোখ গেল সুকন্তর। মা এখনও হাসছেন, কিন্তু চোখে যেন এখন অনেক প্রশ্ন। কি রে সুকু, এত মায়া কিসের? যাবি বললি যে? এত দেরি কেন তবে? ফিরে এলি কার টানে আবার?

সুকান্তর হঠাৎ মনে হল তার এবারের অভিমান মায়ের প্রতি নয়। এবার সে অন্য কারও উপর অভিমানে ঘরছাড়া হতে চলেছে। মায়ের ছবিটাও যেন সায় দিল তার দিকে চেয়ে। জলের বোতলটা বুড়ির হাতে দিয়ে বলল, —আমি এবার যাব।

—কোথায় যাচ্ছ বলবে না? বুড়ির চোখ ছলছল। মণি দু’টো একটু এদিক সেদিক হলেই বুঝি লবণধারা গড়িয়ে নেমে আসবে ওই নরম গাল বেয়ে। বিদ্যুৎ চমকের মতন মনে গেল সুকান্তর, ওর ভালো নাম নীলাঞ্জনা।

তীব্র শিশের শব্দে চমকে উঠল সুকান্ত। পাতাবাহারের ডালে ফিঙেটা এসে বসেছে। এই সময়ে তো আসে না! আজ এই অসময়ে এত পুলক কেন? এবার সত্যিই দেরি হয়ে যাচ্ছে। কাঁধের ব্যাগটা পাশে নামিয়ে রেখে সুকান্ত বলল, —নিকুঞ্জদার কাছে। তুমি একটু বস, আমি এখুনি আসছি।

-- সমাপ্ত --

Comments

Popular posts from this blog

ছুটি

প্রতিশোধ

পরশ পাথর