আয় বৃষ্টি ঝেঁপে

 

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে

রাজ চক্রবর্ত্তী



 

ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েই আকাশের গম্ভীর ভাবটা চোখে পড়ল অদিতির চারিদিকে থকথকে কাদার মতন মেঘ ছড়িয়ে রয়েছে। খাতায় কলমে বর্ষা এসে গেলেও এখনও বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়নি একদিনও। আজ সকালেও ঝলমলে রোদ দেখেই বেরিয়েছিল বাড়ি থেকেসঙ্গে ছাতাও আনেনি অদিতিতার ছাতা হারাবার রোগটা বেশ পুরোনো। তাই ছাতা বইতে তার বড়ই অনিহা। খুব বিপদে না পড়লে ঐ বস্তুটি সে বরাবর এড়িয়েই চলে।

ছাতার যে তার খুব প্রয়োজন হয় এমনটাও নয়। রোজ সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় আসতে তিন চার মিনিটের বেশি লাগে না। আর ইউনিভার্সিটির গেটেই বাস নামিয়ে দিয়ে যায়, কাজেই.....।

অদিতির জীবনের বৃত্তটা বাড়ি আর ইউনিভার্সিটির মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে আজ পনেরোটা বছর। এর বাইরে অন্য কিছু করার কথা সে ভাবে না। আর এখন তো বয়েস প্রায় পয়তাল্লিশ পেরিয়ে গেল। শরীরও আজকাল নিতে পারে না বেশি। তার মনে একটাই চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

আজ ঘুম ভাঙতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। মায়ের শোওয়ার ঘরের জানলাটা সকালে খুলে চলে এসেছে ভুল করে। আজকাল প্রায়ই এমন হচ্ছে অদিতিররান্নায় নুন দিতে ভুলে যাচ্ছে, ঘরের পাখা চালিয়ে চলে আসছে, আবার কখনও জানলা বন্ধ করতে ভুলে হচ্ছে এখন যদি বৃষ্টি নামে জলের ঝাটে বিছানা ভিজে একসা হবে। মনে মনে একটু বিরক্ত হল অদিতি

মায়ের পক্ষাঘাতগ্রস্ত শরীরটা পড়ে রয়েছে আট বছর ধরেঅ্যামায়োট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস নার্ভের কোষগুলো ক্রমশ ধ্বংস হচ্ছে। জুবুথুবু হয়ে অসাড়ে পড়ে থাকে বিছানার এক কোণে। এখন কথাও অস্পষ্ট হয়ে আসছে দিনদিন। সময় হয়ত আর বেশি নেই। অদিতির জীবনের একমাত্র সম্বল। এরপর একা একা থাকা, একা একা বাঁচা।

‘অদিতিদি... একটু আস্তে...’

পিছন থেকে নিজের নামটা শুনে মাথায় চলতে থাকা চিন্তার তাল কেটে গেল অদিতির। তাপস হাঁপাতে হাঁপাতে সামনে এসে দাঁড়ালো।

‘উফ্, কখন থেকে ডাকছি! মনটা কোথায় থাকে তোমার দিদি?’

তাপস ছেলেটি বেশ। খুব মিশুকে। কিন্তু ওর দিকে অদিতি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। একজনের কথা মনে পড়ে যায়। দু’জনের মুখে এত মিল।

‘কিছু বলবে?’ জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় অদিতি।

‘বলবো বলেই না ছুটতে ছুটতে আসলামদাঁড়াও বাবা, আগে একটু দম নি।’ তাপসের নিঃশ্বাস এখনও ঘন।

ওর অবস্থা দেখে অদিতির হাসি পেলএর আগেও এই কথাটা অনেকবার শুনেছে সে। দূর থেকে যেন স্মৃতির তরঙ্গ বেয়ে ভেসে এল সেই গলা। কতকাল আগে যেন!

বাবা অসময়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই শুরু। অদিতির তখন পঁচিশ বছর। বাবার চাকরিটা পেয়ে গেল বলে সংসারটা বেঁচে গেল। বাড়িতে লোক বলতে তখন তিনজন। মা, অদিতি নিজে আর আর ছোট ভাই অনুপ। ছোট ভাইটাকে মানুষ করা তখন একমাত্র লক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। পড়াশুনায় এত ভালো ছিল ছেলেটা! বাবাও অনেক আশা করতেন ছেলেটাকে নিয়ে। চলে যাওয়ার দিনও সকালে ইলিশ মাছ নিয়ে এলেন অনুপ ভালোবাসে বলে। একসাথে সবাই বসে হৈহৈ করে খাওয়া হবে বলে মাকে তাড়া দিলেন কতবার। কিন্তু দুপুরের খাওয়া আর হল না লোকটার। বাথরুমে স্নান করতে করতেই বুকের ব্যাথায় ঢলে পড়লেন। দশ থেকে পনেরো মিনিট। সব শেষ।

‘আবার কোথায় হারিয়ে গেলে?’ তাপস আলতো করে খোঁচা দিল হাতে।

‘হুম! শুনছি তো! বল কি বলবে?’ কপালে জমতে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো আলগোছে মুছে নিল অদিতি।

‘কোথাও একটু বসলে হত না?’ পাশের চায়ের দোকনাটার দিকে নজর তাপসের।

‘আমার দেরী হয়ে যাবে তাপস। দেখছো তো আকাশের অবস্থা! বাড়িতে মা একা।’

‘জানি তো! তাও একটু এসই না বাবা! আমি ট্যাক্সি করে পৌছে দিয়ে আসব তোমায়।’ তাপস নাছোড়বান্দা।

অগত্যা। চায়ের দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিটায় বসতেই হল অদিতিকে।

‘চা খাবে তো?’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই তাপস চায়ের অর্ডার দিতে চলে গেল সামনে। বেশ ভিড় সেখানে। কিছু লোক তাড়াতাড়ি বিকালের নেশা মিটিয়ে নিচ্ছে। সকলেরই এখন বাড়ি ফেরার তাড়া।

স্কুল ফাইনালে ভালো রেজাল্ট করে কলেজে গেল অনুপ। তখন থেকেই টিউশন করে নিজের খরচ চালায় সে। দিদির হাতেও কিছু দেয়। মাস কয়েক বেশ সুন্দর কেটে গেল। তারপরই বিপর্যয়। প্রথম প্রথম লুকিয়ে-চুরিয়ে শুরু, তারপর প্রকাশ্যে এল ওর ড্রাগ নেওয়ার ঘটনা। টিউশনগুলো গেল আস্তে আস্তে। কলেজ থেকে রাসটিকেট করা হল। পাড়ায় সবার চোখে ঘৃণা। আত্মিয়স্বজন মুখ টিপে হাসতে লাগল। গায়ে পড়ে জানতে এল, কি করে এমন হল? বাপ মরা ছেলে, আহা এত অল্প বয়েসে সঙ্গদোষে উচ্ছন্নে গেল! তোমরা কি করছিলে? একটু চোখে চোখে রাখতে পারতে তো! অদিতির অফিসেও আঁচ গিয়ে পৌছেছিলচিরকাল চুপচাপ সে। প্রতিবাদ করতে পারে নি সেবারও। আর কি প্রতিবাদ করবে! কি বলবে! সব অভিযোগই তো মিথ্যা নয়। মায়ের শরীর আরও ভেঙে পড়তে লাগলো।

‘দিদি চা।’ কাঁচের গ্লাসটা এগিয়ে দিল তাপস।

আকাশের বুক চিরে গম্ভীর স্বরে মেঘ ডেকে উঠল। মেঘের নিনাদে আশেপাশের ভিড়টা আরও চঞ্চল হয়ে উঠল। সেদিকে এক ঝলক তাকিয়ে চায়ের গ্লাসটা দু’হাতে জাপটে ধরলো অদিতি। প্রিয়জনের হাত জড়িয়ে ধরলে যেমন ওম পাওয়া যায় তেমন উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল তার হাতের তালু জুড়ে। বহুযুগ সে এমন উত্তাপ খুঁজে চলেছে। নিজের অজান্তেই একটা স্বস্তির আওয়াজ বেরিয়ে এল অদিতির গলা থেকে।

‘দিদি একটা কথা বলি?’ ধপ করে পাশে বসে বললো তাপস। ছেলেটা এইরকমই। কোন কাজই যেন ধীরেসুস্থে করতে পারে না।

অদিতি তখনও অন্যমনস্ক। উদাস চোখে তাপসের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি বলবে?’

‘ইয়ে মানে ডিপার্টমেন্টে নতুন যে মেয়েটা এসেছে না! তোমার পাশের চেয়ারে বসছে গত সোমবার থেকে। ঐ যে গো শ্রাবণী...।’ কথাটা শেষ না করে মাঝপথে থেমে গেল তাপস।

‘কি?’ অদিতির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল একবার। চায়ের গ্লাসে আলতো চুমুক দিয়ে সোজা তাপসের চোখের দিকে তাকিয়ে অদিতি বলল, ‘বলবে তো! শ্রাবণী কি?’

‘না মানে, মেয়েটা বেশ তাইনা? বেশ শান্ত ভদ্র, তোমার মত।’ নিজের হাত কচলাতে থাকে তাপস।

‘তো?’

‘না মানে আমার হয়ে ওকে যদি একটু বল।’ তাপস অসহায় চোখে তাকায় অদিতির দিকে। ‘তুমি বললে ঠিক মানবে। আমায় তো এত বছর ধরে দেখছো, কোন বদগুণ আমার আছে, বল?’ কথাটা বলেই তাপস জিভ কাটে। অদিতির অতীতটা সে জানে।

চকিতে একবার মুখ তুলল অদিতি, ‘আমায় কি করতে হবে?’ চায়ের গ্লাসের উত্তাপ কমে আসছে ক্রমশ। সেই সঙ্গে অদিতিরও।

‘দিদি রাগ কোর না প্লিজ। শেষ কথাটা মুখ ফসকে বলে ফেলেছিতাপস হাত জোর করে।

‘নাহ্! ঠিক আছে। আচ্ছা বেশ আমি শ্রাবণীকে বলবো তোমার কথা। নিরুত্তাপ জবাব দেয় অদিতি।

‘দিদি আর একটা কথা বলি!’

‘কি?’ চায়ের গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে সেটা বেঞ্চের তলায় রাখা ছোট গামলাটায় চুবিয়ে দেয় আদিতি।

‘আমায় দেখে তোমার কার কথা মনে পড়ে গো? তোমার ছোট ভাই, না?’ গলা নামিয়ে বলে তাপস।

‘কে বলল তোমায়?’

‘শুনেছি, তুমি সুতপাদি অর্পিতাদিকে বলেছ। তুমি আমার দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পার না। আমি তো তোমার ভাইয়েরই মতন, বল!’

‘আমি উঠি। আমার এবার সত্যি দেরী হয়ে যাচ্ছে।’ আর কোন জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায় অদিতি।

কাঁধের ব্যাগটা খুলতে যেতেই রে-রে করে তেড়ে আসে তাপস, ‘আহা কর কি কর কি! আজ আমায় তোমার সেবা করতে দাও।’

আরও একবার চমকে ওঠে অদিতি। অনেক দূর থেকে যেন ভেসে আসে কথাগুলো। কত যুগ পরে! হাতের তালুতে জমে থাকা চায়ের গ্লাসের উষ্ণতা হারিয়ে গিয়েছে অনেক্ষণ, তবু শিরায় যেন সেই স্পর্শের রেশ রয়েই যায়।

আকাশের যা অবস্থা আজ বোধহয় বৃষ্টি হবেই। থমথমে আকাশের চিত্রটা আরও প্রকট হচ্ছে হালকা বিদ্যুৎ চমকের সাথে সাথে। এক ঝলক জ্বলে উঠেই আবার নিভে যাচ্ছে আলো। বর্যার প্রথম বৃষ্টি নামার আগে একটা ভ্যাপসা গুমোট ভাব যেন জরিপ করে নিচ্ছে আশেপাশের মানুষগুলোকে। গ্রীষ্মের শেষ তুলির টান দিয়ে একটা ঋতু চলে যাচ্ছে, সেই দুঃখেই বুঝি বর্ষার মন একটু খারাপ। যদিও এ শহরে গরমেরই প্রাদুর্ভাব বেশি, তাও ক্যালেন্ডারে ঋতুর বিদায় তো!     

অদিতির ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে। বাসস্টপে দাঁড়াবার সাথেসাথেই বাস পেয়ে গেল। আবার বাসে উঠেই জালনার ধারে একটা সিট। তাপস জানলার বাইরে এসে থামল। হাত তুলে একগাল হেসে বলল, ‘দিদি কাল আসছ তো? আমি কাল ডুব দেব। বাড়িতে একটু কাজ আছে। শ্রাবণীকে.....।’ ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই বাসটা ছেড়ে দিল। অদিতি মাথাটা বাসের জানলার গায়ে এলিয়ে দিল।

অনুপ কত ভালো ছাত্র ছিল। অদিতির থেকে তো অনেক ভালো। কিন্তু একটা ঘটনা সব ওলটপালট করে দিল। যেদিন ট্রেনে কাটা পড়া অনুপের দেহটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল, মা জ্বরে বেঁহুশ। একা অদিতি সব কাজ সেরেছে সেদিন। শ্মশানে মুখাগ্নি থেকে ডেথ সার্টিফিকেট কালেকশন পর্যন্ত। পাড়ার জানলাগুলো সব অসময়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। কে আর এইসব হুজ্জতে যেতে চায় আজকাল! রাগে; ঘেন্নায়; অভিমানে সেদিনের পর থেকে ছোট ভাইয়ের আর কোন অস্তিত্ব রাখেনি অদিতি।

ছোট ভাইটা চলে যাওয়ার পর নিজেকে আরও শক্ত করেছে। এতদিন ওকে সুস্থ করে তোলার যে লড়াইটা চালাচ্ছিল সেটা হঠাৎ করে পালটে গেল। ভাইয়ের বদলে মা। বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়া অনেক সহজ সেটা অনুপ প্রমাণ করে দিয়ে গিয়েছে। চাইলাম আর দুম করে..... কিন্তু লড়াই করার মধ্যে যে সার্থকতা তার স্বাদ সবাই পায় না। সবার সহ্য হয় না। তাই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার...।

ছেলেটাকে প্রায়দিনই অফিস থেকে ফেরার পথে পিছন পিছন আসতে দেখেছে অদিতি। শান্ত মেয়েটা সেদিন একটু উগ্র হয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

‘কি চাই আপনার! রোজ ফলো করেন কেন?’

ছেলেটা থমকে গেল। অবাক চোখে চাইল অদিতির দিকে। তারপর একটু কাছে সরে এসে বলল, ‘আপনাকে ভালো লাগে তাই।’

সোজাসাপ্টা উত্তর। কোন রাখঢাক নেই। অদিতি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। কুঁকড়ে গেল নিজের ভিতরে। ভালো লাগে! তাকে ভালো লাগে? কয়েক মুহূর্ত সময়। প্রায় দৌড়ে বাড়ির দিকে চলে গেল অদিতি।

রাতে শুতে যাওয়ার আগে অনেক্ষণ নিজেকে সেদিন আয়নায় দেখেছিল অদিতি। ভালো লাগে, তাকেও কারও ভালো লাগে! কি নাম যেন ছেলেটার? যাহ্! নামটাও তো জানা হয়নি। যেভাবে পালিয়ে এল সে!

জীবনযুদ্ধে ক্ষণিক রণাবসান মন্দ লাগে না। হালকা হাওয়ায় শরীর ভাসিয়ে সমুদ্রের পাড়ে ঢেউয়ের উথাল পাতাল ছন্দে নিজেকে ছেড়ে দিতে মন চায়। অদিতিও তাই করল। সংসার নাম শ্বাপদের আক্রমনে বিধ্বস্থ এক লড়াকু মেয়েরও যে নিজস্ব কিছু চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে সেটা তারা নিজেরাই অনেক সময় ভুলে যায়।

সময় বড় গতিশীল। এটা বাবা আর ভাইয়ের হঠাৎ চলে যাওয়া অদিতিকে শিখিয়েছে। দিন পাঁচেক বাদে আবার ছেলেটাকে দেখা গেল অদিতির পিছনে। এবার আদিতি আর ঘুরে দাঁড়ালো না। হাঁটার ছন্দ স্লথ করে তাকে পাশে আসার সুযোগ দিল। একদিন; দু’দিন; তিনদিন। একসময় তারা পাশাপাশি চলে এল। সুজয়।

সময় বড় কম। দু’টো বছর কোথা দিয়ে যেন কেটে গেল। সুজয় এখন সোজা ইউনিভার্সিটির গেটে চলে আসে। অপেক্ষা করে থাকে অদিতির ফেরার। অদিতি ইচ্ছা করে না দেখার ভান করে এগিয়ে যায় সামনে। সুজয় ছুটতে ছুটতে এসে বলে, ‘উফ্, কখন থেকে ডাকছি! মনটা কোথায় থাকে তোমার?’

‘এ মা তুমি!’ দুষ্টুমি ভরা চোখে উত্তর দেয় অদিতি।

‘উফ্! ছুটতে ছুটতে এলামদাঁড়াও বাবা, আগে একটু দম নি।’

তারপর একসাথে কোনদিন কফি হাউস কিংবা আউটরাম ঘাট। সুজয় চুপ করে বসে তাকে অদিতির হাত নিজের হাতের তালু বন্দি করে। অদিতি বিলি কাটে সুজয়ের কোঁকড়ানো চুলে। যেন এক নিখাদ প্রেমের গল্প।

সেদিন কি একটা কারণে সুজয় আসতে পারে নি। অদিতি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাড়ির পথে রওনা হল। বড়রাস্তার ধারে বাস থেকে নেমেও সুজয়কে দেখা গেল না। সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। দিনের শেষ ধূষর লাল ধীরে ধীরে কালো রঙে মিশে যাচ্ছে। আশেপাশের বাড়িগুলোতে শাখের আওয়াজ রাত্রির আগমনকে অভ্যর্থনা করছে যেন।

সেকেলে দু’টো বাড়ির মাঝখান দিয়ে সরু অন্ধকার গলিটা চলে গিয়ে দু’দিকের দু’টো রাস্তাকে জুড়েছে। গলিটা দিয়ে গেলে শর্টকাট হয় একটু। শেষ বারের মতন এদিক ওদিক তাকিয়ে গলিতে ঢুকে গেল অদিতি।

মাঝ বরাবর আসতেই আঁধার ফুঁড়ে একটা ছায়ামূর্তি সামনে উঠে এল। চমকে অদিতি দু’পা পিছিয়ে গেল। কে? কে ওটা?

কিছু বুঝে উঠবার আগেই ছায়ামূর্তিটা মুখ চেপে ধরল অদিতির। চোখে ধাঁধা লাগলেও স্পর্শ চিনে নিল ঠিক।

‘সুজয়!’ অস্ফুটে বেড়িয়ে এল অদিতির মুখ দিয়ে।

‘তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। কেমন দিলাম?’ হেসে উঠল সুজয়।

‘আহ্!’ বিরক্ত হয় অদিতি। ‘আর একটু হলে আমি হার্টফেল করছিলাম। তুমি একটা যা তা!’

সুজয় কোন উত্তর দেয় নাঅদিতির গালদু’টো চেপে ধরে নিজের ঠোঁট মিশিয়ে দেয় অদিতির শুকনো ঠোঁটে।

শরীরে একটা শিরহণ জেগে ওঠে অদিতির। এক অপার্থিব ভালোলাগা। কয়েকটা মুহূর্ত। গা গুলিয়ে উঠল অদিতির। এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নিল সে। তার চোখে অপার বিষ্ময়। অন্ধকার যেন চারদিক থেকে চেপে ধরছে তার গলা।

অস্ফুট স্বরে সে সুজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সুজয়... সুজয় তুমি মদ খেয়েছ?’

সেই শেষ। আর কোনদিন তার দেখা হয়নি সুজয়ের সাথে। সজয় অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু অদিতিকে কোনভাবেই টলাতে পারে নি। অদিতি ঘেন্না করে নেশাখোরদের। আরও কঠিন হল আদিতি। অফিস আর বাড়ি এই তার জীবনের গন্ডি।

অনেক পরে অদিতি খবর পেয়েছিল সুজয়ের। নিজেকে শোধরাতে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে গিয়েছিল সে। হয়ত ফিরতে চেয়েছিল জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে। কিন্তু নেশা সে ছাড়তে পারে নি। ফিরে এসে আবার শুরু করেছিল মদ খাওয়া।

সুজয়ের বাবা নিজেই একদিন এসেছিলেন অদিতির অফিসে। এমনই এক বর্ষা শুরুর বিকেল। অদিতির হাত দু’টো ধরে বলেছিলেন, ‘বাঁচাতে পারলাম না মা। তিনবার রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে পাঠিয়েছিলাম। ফিরে এসে কয়েকদিন বাদেই আবার। শেষ বার ওরা এমন মার মারল যে....। শুধু তোমার নাম করত। তুমি পাশে থাকলে হয়ত.....। গলার স্বর জড়িয়ে গিয়েছিল বৃদ্ধের।

সেদিনও ছাতা নেয়নি অদিতি। বর্ষার প্রথম মুষল ধারা বৃষ্টি। চোখের জল মিশে গিয়েছিল সেই ধারায়। লড়াই করা মেয়েদের যে কাঁদতে নেই।

বাস থেকে নেমে আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইল অদিতি। দু’চার ফোঁটায় শুরু হয়েছে বর্ষার প্রথম বৃষ্টি। আজ তার আর তাড়া নেই। আজকের দিনটা তার নিজস্ব। নিজের জন্য স্বযত্নে তুলে রাখা এই একটা দিন। একটা দিনই তো!  

জোড়া বাড়ির মাঝের গলিটা এখনও অন্ধকারে অদিতির প্রতিক্ষাতেই যেন অপেক্ষা করে থাকে। সে আসবে বছরের এই একটা দিন। এক বছর বাদে আবার নোনতা জলের ধারা নেমে এল অদিতির দু’চোখের কোলের আশ্রয় ছেড়ে। প্রতি বছরই আসে। বর্ষার এই প্রথম প্রবল বর্ষণের দিনে

তাপস বলছিল ওকে দেখে নাকি অদিতির ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। তা বলুক। এটাই সবাই জানুক। তাপসকে যে দেখতে সুজয়ের মতন সেটা কেউ নাই বা জানল। শান্ত অদিতির জীবনের সেই তিনটে বছর ঢাকাই থাক না আকাশের ঐ কালো কাদাটে মেঘের অন্তরালে।

 

--- সমাপ্ত ---

Comments

Popular posts from this blog

ছুটি

প্রতিশোধ

পরশ পাথর