অভিমান
অভিমান
অনেকদিন পর আজ আবার পশ্চিমের ছোট ব্যালকনিতে এসে বসেছেন শঙ্কর। খুব প্রিয়
একটা জায়গা। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় এখানে। একসময় অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার মুখে
এখানে বসেই চায়ের কাপে আলতো চুমুক দিতে দিতে সেদিনের মতন অস্তমিত সূর্যের হারিয়ে
যাওয়া দেখতেন তিনি আর সুলেখা। চায়ের কাপ ঠোঁটে ছুইয়েই বলতেন, —উফ সুলেখা, তুমি চা
এত কড়া বানাও কেন? তোমার সারাদিনের রাগ কি এতেই গুলে দাও। বলে নিজেই হাসতেন।
সুলেখা
সন্ধ্যাকাশের দিকে তাকিয়ে বেশিরভাগ দিনই এই সময় কোন একটা রবীন্দ্রসংগীত গুনগুন
করতেন। গলা থামিয়ে তিনিও কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন, —যদি দিয়েও থাকি, বেশ করেছি। আচ্ছা
আমার সারাটা দিন কিভাবে কাটে একবার ভেবেছ? নিজের অফিস আর কাজ নিয়েই তো সারাটা
জীবন কাটিয়ে দেবে মনস্থ করেছ!
শঙ্কর এই সময় ডান
হাতটা বাড়িয়ে সুলেখার হাত নিজের মুঠোয় তুলে নিতেন। জানতেন সুলেখার সমস্ত অভিমান
ধুয়ে যাবে এই স্পর্শে। মৃদু স্বরে বলতেন, —আর কয়েকটা দিন। তারপর সে আসবে তোমার
কোল আলো করে...
সন্তান যে তিনি
চাননি তেমন নয়। কিন্তু আরও কিছুদিন পর। আরও কয়েকটা বছর যাক। একান্ত নিজস্ব
দাম্পত্য জীবন আর একটু উপভোগ করে তারপর নাহয় সেই গুরু দায়িত্বের মধ্যে যাওয়া
যাবে! কিন্তু শঙ্কর যেটা বুঝতে পারেননি সেটা হল, সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। বেশি
দেরী হলে সেটার আর যথার্থতা থাকেনা।
সেদিনও সুলেখার
হাত নিজের তালুবন্দি করেছিলেন শঙ্কর। নিজের ঠান্ডা হাত শঙ্করের তালুতে ছেড়ে দিয়ে
সুলেখা বলেছিলেন, —ফিরে আসব তো?
নাহ্! ফিরে আর আসেনি
সুলেখা। বেশি বয়সে সন্তানের
জন্ম দিতে গিয়ে দু’জনেই চলে
গেল। নাসিংহোমের ছোট কেবিনে সেদিন সুলেখার ঠোঁটের ধারে এক অদ্ভুত হাসি যেন
দেখতে পেয়েছিল শঙ্কর। শেষ সময় বোধহয় একটু কেঁদেছিলেন। চোখের কোণে
একবিন্দু জলকণা তখনও চিকচিক
করছিল। কার জন্য আজও জানেন না শঙ্কর। না পাওয়া সন্তান, না ছেড়ে যাওয়া স্বামী!
কোনটা বেশি আঘাত করেছিল সুলেখাকে!
শেষবারের মতন
সুলেখার হাত নিজের হাতে নিয়েছিলেন শঙ্কর। কিন্তু সেদিন অভিমান আর ধুয়ে যায়নি। কপট
রাগে আর মুখ খোলেননি সুলেখা। বরং তীব্র অভিমান এসে জায়গা করে নিয়েছিল শঙ্করের বুক
জুড়ে। যত রাগ গিয়ে পড়েছিল ওই পশ্চিমের ব্যালকনিটার উপর। সুলেখার সবচেয়ে প্রিয়
জায়গা। প্রতিটা সন্ধ্যা এখানে কত অলস সময় বয়ে গিয়েছে। দিনের পর দিন দুটো মানুষের
নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে নিজেকে সচল রেখেছে এই ছোট্ট জায়গাটা।
অনেক পরিকল্পনার
সাক্ষী এই ব্যালকনি। নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়ার আগের দিনও এখানে অনেক রাত অবধি
বসেছিল তারা। নতুন অতিথিকে নিয়ে কত আলোচনা! এখন তারা মৃত। আর প্রাণবায়ু ঘিরে
থাকবে না এই জায়াগায়। থাকতে দেবেন না শঙ্কর। দরজাটা বন্ধ করে চাবিটা অফিস যাওয়ার
পথে প্রবল আক্রোশে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়েছিলেন বাইরে।
এসব অনেক দিন আগের
কথা। মাঝে বয়ে যাওয়া সময়ের চোরা স্রোতে অনেক স্মৃতিই আজ ঝাপসা শঙ্করের কাছে।
বয়েস ভুলিয়ে দিয়েছে অনেক কথা। আবার অনেক স্মৃতি নতুন করে কাছেও ভাসিয়ে এনেছে। আজ তাদের
মৃত্যুদিন। সুলেখা আর সেই পৃথিবীর আলো না দেখা সে। কুড়ি বছর হল। ব্যালকনির দরজার
তালা সকালে মিস্ত্রি দিয়ে ভাঙিয়েছেন শঙ্কর। সারাদিন নিজের হাতে পরিষ্কার করেছে
ঝুল। মেঝেতে জমে থাকা পুরু ময়লার আস্তরণ সরিয়ে খুঁজেছেন সুলেখার পায়ের শেষ স্পর্শ।
আজকাল আর কিছুই
তেমন মনে রাখতে পারেন না। খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আর মনে করতে পারেন না খেয়েছেন
কিনা! ওষুধ খেতেও ভুলে যান প্রায়ই। অসমর্থ শরীর আর মন নিয়ে একা সবকিছু পরিষ্কার
করে আজ আরও ক্লান্ত তিনি। এত বছর পর কিসের তাগিদে, কেন তিনি এসব করছেন নিজেও জানেন
না শঙ্কর।
ঘরে সুলেখার কোন
ছবিও রাখেননি শঙ্কর। ব্যালকনিতে তাদের যুগল একটি ছবি টাঙানো ছিল। সেটা আজও রয়ে
গিয়েছে। ঘষে ঘষে কাঁচ চকচকে করে দিয়েছেন তিনি। অনেক বছর পর আবার সুলেখাকে দেখলেন
শঙ্কর। ওর মুখটা এতদিনে ঝাপসা হতে শুরু করেছিল। ঠোঁটের কোণে হাসিটা খুব পরিচিত।
চলে যাওয়ার দিন এই হাসিটাই কি ঘিরে ছিল সুলেখাকে?
সন্ধ্যা হতে আর
বেশি দেরী নেই। সূর্য ঢলছে পশ্চিম আকাশে। চেয়ারে বসে সেদিকে তাকিয়ে নিজের হাতে
তৈরি চায়ের কাপে চুমুক দিলেন শঙ্কর। নিজেই মনেই বললেন, —তুমি চা এত কড়া বানাও কেন
শঙ্কর? কার উপর এত রাগ তোমার? কিসের এত অভিমান? সময় তো হল!
দেওয়ালের টাঙানো
ছবিটা নামিয়ে একটা ছোট টেবিলের উপর রেখেছেন। একটা রজনীগন্ধার মালা দিয়েছেন। লোকে বলে জীবিত
মানুষের ছবিতে মালা দিতে নেই। কিন্তু তিনি কি আর আদৌ জীবিত!
রজনীগন্ধার গন্ধে
গোটা ব্যালকনিটা দুলে উঠছে যেন। ভিতর থেকে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন শঙ্কর। চাবিটা
ছুঁড়ে দিয়েছেন এই চারতলা থেকে। পাশেই একটা বন্ধ কারখানা জমি জঙ্গলে ভরে রয়েছে।
সেখানেই পরম নিশ্চিন্তে হারিয়ে গিয়েছে চাবিটা। আশেপাশের বাড়িগুলোয় একটা একটা করে
আলো জ্বলে উঠছে। কারোর সময় নেই অন্যের খবর নেওয়ার। নিজেদের মতেন এভাবেই তারা
জ্বলবে। সময় শেষে আবার নিভেও যাবে।
আজ আর কোন অভিমান
নেই শঙ্করের। এখন আছে শুধুই অপেক্ষা। চোখ বন্ধ করে সুলেখার
প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত গুনগুন করে উঠলেন শঙ্কর। সূর্যটা ঝুপ করে হারিয়ে গেল সেদিনের
মতন।
Comments
Post a Comment