একটি প্রাণ একটি গাছ


 

দুপুরে এলাহি খাওয়া-দাওয়ার পর বিশাল একটা ঢেঁকুর তুলে দুঁদে উকিল জয়দেব শিকদার চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। আজ অনেকদিন পর মেয়ে জামাই এসেছে। নিজে বাইরে যেতে পারছেন না তো কি হয়েছে! তার বাড়িতে সবজি, মাছ-মাংস পৌছে দেওয়ার লোকের অভাব নেই। এক ফোনেই সব কাজ হয়ে যায়।

জামাই অর্ক হাত ধুয়ে বসার ঘরে এসে ঢুকতেই জয়দেব বললেন,-মাংসটা কেমন খেলে বল অর্ক? খাস বারবারি জাতের খাসি বুঝলে! অনেক কষ্টে জোগার করেছি তোমাদের জন্য।

মেয়ে সুলতা বিয়ের পর গত চার বছর মুম্বাইতেই ছিল অর্কর সাথে। অর্ক সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সম্প্রতি সে মুম্বাই থেকে কলকাতার অফিসে বদলি হয়ে এসেছে।

সেই থেকেই জয়দেব আর সাবিত্রি বলে চলেছেন তাদের কয়েক দিনের জন্য এসে থেকে যেতে। কিন্তু লকডাউনের জন্য আসব আসব করেও আর আসা হয় না। এর মধ্যেই আবার আমফানের ধাক্কায় কলকাতা বিধ্বস্ত হল। জয়দেব আর সাবিত্রি মেয়েকে দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠলেন। অবশেষে আজ তারা এসেছে।

অর্ক উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসলো কেবল। সে জানে তার শ্বশুর জয়দেব একজন দাম্ভিক প্রকৃতির মানুষ। তাঁর প্রতিটা কথাতেই অহঙ্কার আর হামবড়া ভাব। অর্ক নিজে যদিও এই ধরনের কথা একদম পছন্দ করে না। মন থেকে শ্বশুরকে প্রণামও করতে ইচ্ছা করে না তার এই কারণে। সুলতার সাথে তার বেশ কয়েকবার কথা কাটাকাটিও হয়েছে এই নিয়ে।

সাবিত্রি আর সুলতা ঘরে একবার উঁকি দিয়েই, আমরা একটু আসছি বলে দোতলার ঘরে চলে গেল। বোধহয় মা-মেয়ের কোন গোপন আলোচনা আছে যা বাপ আর জামাইয়ের সামনে করা চলবে না।

অর্ক জয়দেবের সামনে বারাবর একটু অপ্রস্তুত বোধ করে। জয়দেবের ঠেস দিয়ে বলা কথাগুলো হজম করতে হবে এখন বসে বসে।

জয়দেব কিন্তু বসলেন না। সোজা বাইরের বারান্দায় চলে গেলেন। ইশারায় অর্ককেও ডাকলেন।

-তোমার অকর্মন্য ছোকড়াদের মতন দুপুরে ঘুমাবার বদ-অভ্যাস নেই আশা করি?

-না! সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল অর্ক।

-বেশ বেশ। তাহলে চল কয়েকটা জিনিস দেখাই তোমায়।

চওড়া বারান্দার শেষে তিন ধাপ সিঁড়ি নেমে গিয়েছে নিচে, তারপর বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে বাগান। বড় বড় গাছের জন্য দুপুরেও জায়গাটা একটা স্নিগ্ধ ছায়ায় ভরে রেয়েছে।      

একপাশের দেওয়ালের গা ঘেঁসে সার দিয়ে রাখা রয়েছে অনেকগুলো প্ল্যাকার্ড। এদের কোনটায় লেখা ‘একটি গাছ, একটি প্রাণ’, কোনটায় ‘গাছ লাগাও, প্রাণ বাঁচাও’ ইত্যাদি।

অর্ক সেগুলোর দিকে তাকিয়ে শ্বশুরের মুখের দিকে অবাক দৃষ্টি দিল।

-এগুলো আজ সকালেই রেডি হয়ে এসেছে। আমফানের ফলে কত গাছ নষ্ট হয়েছে, টিভিতে দেখেছো আশা করি!

-হ্যাঁ, তা তো…

অর্ককে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে জয়দেব বললেন,-কাজেই এখন আমাদের নৈতিক দায়িত্ব আবার নতুন করে গাছ লাগানো। আর এই অঞ্চলে তোমার শ্বশুরের দাপট তো তুমি জান না! তুড়ি মেরে সব করিয়ে নিতে পারি।

-ও! ঘাড় ঘুরিয়ে শান্ত গাছের ছায়ার দিকে তাকায় অর্ক।

-বিকেলে পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা এলেই বেড়িয়ে পড়া হবে। স্টেশন, বাজার, বাসস্ট্যান্ড সহ প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে প্ল্যাকার্ডগুলো।

একটু থেমে জয়দেব বলে চললেন,-কাল সকালে আনা হবে দু’হাজার চারা গাছ। তারপর সেই গাছ পুঁতে দেওয়া হবে চতুর্দিকে। আমফানে যে ক্ষতি হয়েছে সবুজের তা ফিরিয়ে আনতে আমি বদ্ধপরিকর। আমার কথায় এই সব কর্মকান্ড হচ্ছে বুঝলে, খরচ সব আমার।

গর্বের সাথে কথাগুলো বলে জয়দেব পকেট থেকে দামি ব্র্যান্ডের সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা ধরালেন। অর্ক মনে মনে বিরক্ত হলেও চুপ করে রইল। সিগারেটের গন্ধটা সে একেবারেই নিতে পারে না।

কথার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠল জয়দেবের। কানে দিয়ে কিছুক্ষণ উত্তেজিত হয়ে কথা বললেন তিনি। ঘন ঘন টান দিলেন সিগারেটে। মিনিট কয়েক পর এক মুখ বিরক্তি নিয়ে মোবাইলটা কেটে দিয়ে বললেন,-যা শুনেছি ঠিক! পাক্কা খবর, যত্তসব! একটু দম নিয়ে অর্কর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,-আমার রাইভাল একজন আছে এখানে বুঝেছ! সনাতন হালদার।  সে শালা আবার কম্পিটিশনে নেমেছে। আমি দু’হাজার গাছ আনছি শুনে সে নাকি তিন হাজারের অর্ডার দিয়েছে। আচ্ছা, ঠিক হ্যায়। আমাদের আরও কম করে দু’হাজার আনাতে হবে বুঝলে। আমি একটু পরেই বের হব। তুমিও চল আমার সাথে। শ্বশুরের ক্ষমতাটা একবার চাক্ষুষ করে যাও।

হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে বাগানে ফেলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন জয়দেব,-তুমি তৈরী হয়ে নাও। আমি দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে আসছি। কুইক, হারি আপ।

অর্কর কোন ইচ্ছাই ছিল না জয়দেবের ক্ষমতার দৌড় দেখার। সে ভেবেছিল বাগানে শান্ত গাছের ছাওয়ায় বসে সঙ্গে আনা বইগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখবে। এমনিতে কাজের চাপে বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় ঘুচেই গিয়েছে আজকাল।

সুলতা আর সাবিত্রিও এর মধ্যে নেমে এসেছে নিচে। তাদের মিটিং শেষ। ঘরে ঢুকে অর্ক দেখল সুলতা বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে একটা স্থানীয় ট্যাবলয়েডের পাতা উল্টাচ্ছে।  

আজ সুলতা খুব খুশি। পর পর দু’বার মিসক্যারেজ হওয়ার পর খুব মনমরা হয়ে থাকে। মুম্বাইয়ের ছোট্ট ফ্ল্যাটটায় সারাদিন দম বন্ধ করে থাকত ও। গত চার বছরে সেটাই যেন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। এখন কলকাতায় শ্বশুরবাড়ি এসেও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। কারো সাথে সেভাবে মিশতে পারে না সুলতা। গুমরে থাকে একা একা। ডাক্তার বলেছে, যতটা সম্ভব তাকে আনন্দে রাখতে। তাই সবার পরামর্শে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এখানে চলে এসেছে অর্ক। এতদিন পর সুলতাকে হাসিখুশি দেখে ভালই লাগল তার।

অর্ককে ঢুকতে দেখেই সুলতা বলল,-এ্যাই, এটাতে আমার বাবার একটা খবর বেড়িয়েছে দেখেছ তুমি?

-নাহ্! কি খবর? অলস গলায় বলল অর্ক।

-বৃক্ষরোপন কর্মসূচি। আমার বাবা দু’হাজার গাছ লাগাবার ব্যবস্থা করছে এই অঞ্চলে।

পুরোনো খবর। এতক্ষণ এই নিয়েই বুড়োর কচকচানি শুনে এসেছে অর্ক। সে কোন উৎসাহ দেখাল না দেখে সুলতা আবার বলল,-কি, বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার?

-হচ্ছে তো! এই মাত্র এই নিয়েই কথা হচ্ছিল গ্রেট জয়দেব শিকদারেরর সাথে। ইনফ্যাক্ট আমরা এক্ষুনি বের হব এই ব্যপারেই।

-কোথায়?

-প্ল্যাকার্ড বিলি আছে, কাল সকালে গাছ আসবে তার তদারকি আছে। সে অনেক কাজ।

-ওহ্ তাই! আমিও যাব। নেচে উঠল সুলতা।

-হ্যাঁ চল না। খুশি হল অর্ক। বুড়োর বড় বড় কথাগুলো তাহলে আর একা হজম করতে হবে না।

-ওকে! আমি এক্ষুনি তৈরি হয়ে নিচ্ছি। তুমি কিন্তু নতুন পাঞ্জাবীটা পড়বে, যেটা মা তোমাকে আজ দিয়েছে। অর্কর গালটা আদরে টিপে দিয়ে চলে গেল সুলতা।

দশ-বারোজনের দলটা স্টেশনের সামনে গিয়ে থামলো। ওরা তিনজন ছাড়া বাকি ক্লাবের ছেলে সব। তারা হাতে করে নিয়ে এসেছে প্ল্যাকার্ডগুলো। এরা জয়দেবকে সবসময় ঘিরেই থাকে বলে মনে হল অর্কর।

স্টেশন চত্ত্বরে কয়েকটা মাত্র দোকান খোলা। ওদের আসতে দেখে তারা সবাই দোকান ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। জয়দেব সাবার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন,-আমি এই অঞ্চল আবার সবুজ গাছে ভরিয়ে দেব, কথা দিচ্ছি তোদের।

-গাছে কি হবে বাবু। পেটে ভাত নেই, মাথায় ছাদ নেই। আপনার চারা গাছের তলায় মাথা গোঁজব নাকি! পাশ থেকে একজন বলে উঠল।

ক্লাবের ছেলেরা তেড়ে গেল তার দিকে। রে-রে করে উঠল সবাই। জয়দেব তাদের হাত তুলে থামালেন,-আহা করিস না, সব ঘরহারার দল।

অর্কর একটুও ভালো লাগছিল না। এখান থেকে চলে যেতে পারলে সে বাঁচে। কিন্তু দুম করে চলে যাওয়া সম্ভব নয় সে জানে। সুলতাও পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ। যে উৎসাহ নিয়ে এসেছিল তাতে ভাটা পড়েছে সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

জয়দেব আবার বললেন,-গাছই তো প্রাণ। গাছ ছাড়া আমরা বাঁচবো কি করে! হাত তুলে ছেলেদের বললেন,-তোরা প্ল্যাকার্ডগুলো ঠিক ঠিক জায়গায় লাগিয়ে দে।

রোগা চেহারার বয়স্ক একজন এগিয়ে এসে বলল,-সনাতন হালদারও তো সকালে এসে বলে গেল গাছ লাগাবার কথা।

জয়দেবের চোখের দৃষ্টি সতর্ক হল। তিনি আড়চোখে একবার মেয়ে জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে গলাটা একটু নামিয়ে বললেন,-কত গাছ কিছু বলেছে নাকি?

-বললে তো তিন হাজার। তেমনই যেন শুনলুম। লোকটা আমতা আমতা করে বলল।

জয়দেব এবার গলা তুললেন,-আমি চার হাজার লাগাব। পল্টু, সন্তু আরও গাছের অর্ডার দিতে হবে। ফোন কর।

-সে হবে খন স্যার। আপনি টেনশন করবেন না স্যার। একদিনে তো আর সব গাছ লাগাচ্ছেন না। পল্টু বা সন্তু কেউ একজন বলল কথাটা।

-সেটাই দেখ একটু। সনাতন হালদার যেন আমার চেয়ে আগে না যেতে পারে। সে দায়িত্ব তোদের। আরও টাকা লাগে আমি দেব।

-সব হয়ে যাবে স্যার। চাপ নেবেন না।

ছেলেদের সব বুঝিয়ে জয়দেব আয়েস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে অর্কর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন,-তুমি তো শহুরে মানুষ, গ্রাম দেখা তেমন হয়নি বোধকরি কখনও!

-নাহ্! হেসে ফেলল অর্ক।

-চল তবে তোমাদের একটু দেখাই। তারপর ক্লাবের ছেলেদের উদ্দেশ্যে বললেন,-তোরা সব কাজ সেরে একবার টাউনে যাবি। আরও দু’হাজার গাছের অর্ডার আজই দেওয়া চাই। আর কাল যেন সকাল সকাল সব চলে আসে, সেভাবে বলে আসবি।

-বপি বাড়ি যাবে না। সুলতা এতক্ষণ চুপ ছিল এবার আদুরে গলায় বলল।

-যাব তো মা। গ্রামের ভিতর দিয়ে যে রাস্তাটা আছে, সেটা দিয়ে যাই চল। অর্কর গ্রাম দেখা হবে আর ঠান্ডা মুক্ত বাতাসে তোরও ভালো লাগবে।

-চল তাড়াতাড়ি মা সন্ধ্যেবেলা জামাইকে আলুর চপ আর মুড়ি খাওয়াবে। সারা দুপুর বসে সব রেডি করেছে। গেলেই গরম গরম ভেজে দেবে।

ওরা সরু মঠো পথ ধরে বাড়ির দিকে ফিরতে লাগল। পশ্চিমের আকাশ শেষ বিকেলের হালকা লাল রঙে নিজেকে ছাপিয়ে নিচ্ছে। আকাশে ভাসা ভাসা মেঘ জমছে এদিক ওদিক। রাতের দিকে বৃষ্টি হতে পারে।

অর্ক ফিসফিস করে বলল,-এই সনাতন হালদার লোকটা কে সুলতা। দুপুর থেকে অন্তত চার-পাঁচবার নাম শুনলাম লোকটার।

-এখানকার লোকাল নেতা। বেশ পসার। শুনছি আসছে ইলেকশনে দাঁড়াবার চিন্তা ভাবনা চলছে, দু’জনেরই… বাবার দিকে আঙুল দেখিয়ে সুলতা গলা নামিয়ে বলল।

ওরা অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। দু’পাশের ঝড়ে বিধ্বস্ত গাছগুলোকে দেখছিল অর্ক। সত্যিই আরও গাছ লাগান দরকার। সবুজ প্রায় পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে।

একটা বাঁকের মুখে এসে হঠাৎ থমকে গেলেন জয়দেব। সামনে একটা বাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে শেষ বিকেলের কনে দেখা আলোয়। তাদের চালগুলো সব উড়ে গিয়েছে। দেওয়ালগুলো হেলে পড়েছে একদিকে, যেকোন সময় সেটাও ধসে যেতে পারে। ঘরের জানলা সব কোনরকমে ঝুলছে কবজা থেকে।

সেখানেও মানুষের বাস। ঘরের সামনের ছোট্ট উঠোনে খেলা করছে তিনটি উলঙ্গ শিশু। নিজেদের খেয়ালে, মনের সুখে। যেন তাদের কোন চিন্তা নেই। নেই কিছু হারাবার ভয়।

সুলতা পিছন থেকে খামচে ধরেছে অর্কর হাত। জয়দেব কয়েক মুহূর্ত নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকে গলা তুললেন,-এ্যাই তোরা কে রে?

তিনটি শিশু মুখ ঘুরিয়ে চাইল এদিকে। তাদের চোখে ভয়। জয়দেব আবার চেঁচালেন,-বাড়িতে আর কে আছে?

তাঁর চিৎকারেই এবার ভিতর থেকে দু’জন মহিলা বেরিয়ে এলেন। মাথার অনেকটা ঘোমটায় ঢাকা। শতছিন্ন শাড়ি অনেক কষ্টে তাদের লজ্জা ঢেকে রেখেছে কোনমতে। 

-কে রে? আবার জানতে চাইলেন জয়দেব।

একজন তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে একটা বাচ্চাকে কোলে তুলে নিল। এতে তার শরীরের ঊদ্ধাংশের ছেঁড়া কাপড় ঢাকা পরে গেল অনেকটাই। এবার সে আস্তে আস্তে এগিয়ে এল সামনে।

-আমি কমলা। আমারে চেনছেন বাবু?

-হুম্! তুইতো হারানের বৌ।

-হ বাবু। আপনে ইদিকে? কাজে বুঝি?

-এদের একটু… আমার মেয়ে জামাই।

-অ।

-এটা তোর ছেলেটা তো! এই চেহারা কেন রে? কত মোটাসোটা ছিল। হারান কই?

-সে বাবু আজ তিনমাস বাইরে। শহরে কারখানায় কাজ করতি গেল। আর ফেরে নাই। এখন কৈ কে জানে! যা বিষ রোগ এয়েচে, বেঁচে আছে কি না কে জানে! খবর নাই গো বাবু।

-ওহ্! তোদের চলছে কি করে? রেশন পাচ্ছিস না?

-কই আর বাবু! ছেলেটারে কিছুই দিতে পারি নে। একদিন খাই তো তিনদিন উপাস।

জয়দেব একটা সিগারেট ধরাতে গিয়েও রেখে দিলেন। অর্ক অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছে কমলা আর তার ছেলের দিকে। সুলতা হাত জড়িয়ে ধরেছে তার। তার মনে বোধহয় দু-দু’বার মিসক্যারেজের বেদনা ফুটে উঠছে আবার। অর্কর মনে হল এইভাবে চললে এই কমলার ছেলেও আর কয়েকদিনেই মরে যাবে। এটাও কি এক ধরনের মিসক্যারেজ নয়? সমাজের মিসক্যারেজ।

-বাকি বাচ্চাগুলো কার? তোরই নাকি? জয়দেব গম্ভীর মুখে জানতে চাইলেন।

-দুইটা আমার বাবু। আর একটা ঐ দিদির। আঙুল তুলে অপর মহিলাটিকে দেখাল কমলা।

জয়দেব কয়েক মিনিট চুপ করে রইলেন। তারপর মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে নিলেন। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে উত্তর এল,-হ্যালেও!

-সনাতন?

-ইয়েস, কে বলছেন?

-আমি জয়দেব শিকদার। তোমার নম্বর আমার কাছে আছে, আমারটাও তোমার কাছে থাকা উচিত ছিল। হাজার হোক আমি তোমার রাইভাল।

-ইয়ে মানে… আমি কদিন আগে ফোনটা পাল্টেছি.. তাই… আমতা আমতা করেন সনাতন।

-তুমি শুনলাম তিন হাজার গাছ লাগাচ্ছ!

-ঠিকই শুনেছেন। সব আমার খরচায়। গর্বের সাথে বললেন সনাতন হালদার।

-ঠিক তো! একদম?

-পাক্কা।

ফোনটা কেটে দিলেন জয়দেব। আবার একটা নাম্বার ডায়াল করলেন।

-হ্যাঁ স্যার।

-পল্টু?

-হ্যাঁ স্যার বলুন। আমরা টাউনে এসেছি স্যার। কাল সকালে সব চারা পৌছে যাবে। অর্ডার কনফার্ম।

-সব ক্যানসেল কর।

-কেন স্যার? কোন সমস্যা? আমাকে বলুন স্যার।

-আমি চারা পেয়ে গিয়েছি আর লাগবে না।

-কোথায় পেলেন… মানে…

-আমাদের গ্রামে, আমাদের পাশের গ্রামে, তার পাশের গ্রামে, সর্বত্র।

-ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার।

-তোর বোঝার দরকার নেই। এই চারাগুলোকে এবার বড় করতে হবে। একটা প্রাণ, একটা গাছ। তোরা পুরো টাকাটা দিয়ে চাল, ডাল, আলু নিয়ে চলে আয়। কাল নয়, আজই চাই আমার।

ফোন পকেটে রেখে জয়দেব মেয়ে জামাইয়ের দিকে তাকালেন, তাঁর চোখ তখন চিকচিক করছে। সুলতা ছুটে গিয়ে বাবার বুকে মাথা রাখলো আলতো করে। অর্ক এই প্রথম মন থেকে প্রণাম করল তার শ্বশুরকে।

Comments

Popular posts from this blog

ছুটি

প্রতিশোধ

পরশ পাথর