শান্তনুর সময়



সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর বাড়ি ফেরা এই সময়টা শান্তনুর নিজস্ব শিয়ালদা থেকে ট্রেনে বাড়ি ফিরতে প্রায় দেড় ঘন্টা লাগে অফিস থেকে একটু আগেই স্টেশনে পৌছায় সে তারপর অপেক্ষা করে থাকে বোর্ডে প্ল্যাটফর্মের নম্বরটা ভেসে উঠলেই পরি কি মরি করে ছুট যে ভাবেই হোক জানলার ধারে একটা সিট চাই প্রায় দিনই পেয়ে যায় মাঝে মাঝে এর জন্য কিছু খেসারতও দিতে হয়। কোন দিন হয়তো পিছন থেকে অন্য লোকের ধাক্কায় কনুইটা একটু ছড়ে গিয়ে নুনছাল উঠে গেল, কিংবা জামার একটা বোতাম বোঁ করে ছিঁড়ে মানুষের ভিড়ে গোত্তা খেতে খেতে হারিয়ে গেল। একদিন তো পা থেকে একপাটি জুতো খুলে লাইনের তলায় চলে গেল। সেদিন খালি পায়েই বাড়ি ফিরতে হল। কিছু করার নেই। এক-পায়ে জুতো পড়ে তো হাঁটা যায় না! আর মাসের শেষে নতুন জুতো কেনার কোন প্রশ্নই আসে না। তবু সে রোজ লড়াইটা করে।

কোন মতে একবার সিটটা পেয়ে গলেই শান্তনু নিশ্চিন্ত তার নিজস্ব সময় শুরু এখন এবার সে মনে মনে চিন্তা করবে নানান চিন্তা কখনও অফিসের বড়বাবুর মুন্ডপাত করবে, কখনও স্ত্রী রমা- ছেলেটা উচ্ছন্নে যেতে বসেছে! তার কথা ভেবে কখনও দাঁত কিড়মিড় রবে আবার কখনও কখনও অন্য রকম কোন চিন্তা মনকে গ্রাস করে নেবে। তার কোন মাথামুণ্ডু নেই। ভাসা ভাসা সব চিন্তা। কোথা থেকে তারা আসে শান্তনু নিজেও জানে না। এক কথায় সে মনকে একদম ছেড়ে দেয়। যা মন নিজের মত একটু বেড়িয়ে নে। যা খুশি কর। মন চল নিজ নিকেতনে। এই দেড়টি ঘন্টা তোর কেউ কাড়তে পারবে না।

এই কারণে সবাই যখন রবিবার এলে খুশি হয়; শান্তনুর মনে মনে গুমরে থাকে। আবার রবিবার! সারাদিন ঘরের হাজারো কাজ সামলাও। রমা-র সব অভিযোগ শোন মন দিয়ে। একটু বেচাল হলেই ঘরে মহাভারত। প্রতিটা পদক্ষেপ বেশ মেপে মেপে ফেলতে হয়। সংসারের সঙ্গে দাবা খেলা। একটি চাল ভুল হলেই কিস্তি-মাত। আর সন্ধ্যার দিকে ছোট শ্যালক সস্ত্রীক বাড়িতে হানা দিলে তো কথাই নেই! রমার মতে বিশ্ব জুড়ে যত প্রকার গুণ দেখা য়ায়, তা তার এই ছোট ভাইটির মধ্যে বিদ্যমান। সব বাড়িতেই যা হয় আর কি!

দিনটা সম্ভবত সোমবার। কারণ এই দিন শান্তনুর মেজাজটা বেশ ফুরফুরে থাকে। সামনে পর পর আরও পাঁচটা দিন। স্টেশনে সে রোজকার মত আগেই চলে এসেছে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সাইনবোর্ডটার দিকে। পা-দুটো ছোটার জন্য স্টেডি। এবার শুধু প্ল্যাটফর্মের নাম্বারটা পেলেই ব্যাস!

তালটা কিন্তু কেটে গেল। হঠাৎ পিছন থেকে আলতো চাপ পড়ল কাঁধে।

-আরে শান্তনু বাবু যে!

অচমকা এই অপ্রত্যাশিত ধাক্কার জন্য শান্তনু মোটেও প্রস্তুত ছিল না। হোক না সেটা আলতো চাপ। তার কাছে সেটা কোন বেরসিকের ধাক্কাই! চমকে পিছন ফিরল সে। মিটমিট করে তার পানে চেয়ে যে লোকটি হাসছে, তিনি তাদের অফিসেরই গুময় বাবু। সদা হাস্যময় গুণময় বাগচী।

কপালে ভাঁজ পড়ল শান্তনুর। এ আবার এই সময় জ্বালাতে এখানে এলো কেন? রোজ তো আরও পরে বের হয়।

-আপনি? আজ এত তাড়াতাড়ি যে? একটু বিরক্ত হয়েই প্রশ্নটা করল শান্তনু।

গুময় বাবু প্রায় সারাদিনই পান চিবিয়ে থাকেন। এখনও মুখ নড়ছে যথা নিয়মে। শান্তনুর সাথে খুব বেশী অন্তরঙ্গতা নেই যদিও। তাছাড়া সে এই অফিসে ট্রান্সফার হয়ে এসেছে মাত্র বছর দুই হল।

আরও কয়েকবার মুখ আমতিয়ে পানটিকে সাইজ করে গুময় বাবু বললেন, -আজ গিন্নীর জন্মদিন কি না! তাই একটু আগেই, মানে হেঁ হেঁ হেঁ …!

আদিখ্যেতা! শান্তনু মনে মনে বলল বুড়ো ভাম! ন্যাকামি দেখলে গা জ্বলে যায়

মুখটা যতটা সম্ভব হাসিমাখা করে শান্তনু বলল, -ওঃ মা! আগে বলেননি কেন? সবাই মিলে তাহলে আপনাকে ধরতাম মিষ্টিটা মিস হয়ে গেল দাদা!

-কি যে বল ভায়া! এই বয়েসে আবার এসব। তাও আবার এই মাসের শেষে। তেমন কিছু নয় বউকে খুশি করতে একটু আগে বাড়ি যাচ্ছি, এই পর্যন্ত

-তা বললে কি হয় গুময়দা! একবার মুখ ফসকে যখন বলে ফেলেছেন… !

কথা হয়ত আরও কিছুক্ষণ চলত; কিন্তু ঠিক সেই সময় বোর্ডের দিকে চোখ গেল শান্তনুর .০২ মিনিটের ডায়মন্ড হারবার লোকাল ১২ নম্বর এ

-পালাই দাদা, আমার ট্রেন বারো নম্বরে, আপনি কোন ট্রেনে যাবেন?

-আমিও এতেই যাব।

শান্তনুর ইচ্ছা করছিল সেই মুহূর্তে গুময়ের জামার কলারটা ধরে মুখে সপাটে একটা ঘুসি মারতে। কিংবা নিজের মাথাটাকেই দেওয়ালে ঠুকে শেষ করে দিতে। এ কি উপদ্রব! এখন গোটা রাস্তাটা এই বুড়োর উপদেশ শুনতে শুনতে যেতে হবে। ছুটে গিয়ে মারপিট করে ট্রেনের জানলার সিট দখলের উৎসাহটাই হারিয়ে ফেলল শান্তনু একটা আলতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্তভাবে পা বাড়িয়ে শুধু বলল, -চলুন!

ব্যাজার মুখেই ট্রেনে উঠে বসল শান্তনু গুময় বাবুর পাশেই রোজ যে নিত্যযাত্রীদের সাথে যুদ্ধ করে জানলার ধারের সিটটা দখল করে, তারা আজ মুখ টিকে হাসছে তাকে দেখে। কারোর দিকে না তাকিয়েও সেটা বুঝতে পারছে শান্তনু। পাশের তাসের আড্ডা শুরু হল একটু পরেইএদের চিৎকারে শান্তনুর কোন অসুবিধা হয় না। সে পাত্তাই দেয়না এদের ঝগড়া বা মাঝে মধ্যে এর ওর দিকে ছুঁড়ে দেওয়া টিপ্পনিগুলোকে। সে নিজের খেয়ালেই থাকে। কিন্তু পাশে অপিসেরই একজন সহকর্মী বসে থাকবে আর মাঝে মাঝে গায়ে পড়ে আলাপ-বিলাপ করবে, আর তাকেও তার কথায় সায় দিতে হবে এ যেন একেবারে যাকে বলে ... ।

গুময় মন দিয়ে তাস খেলাটাই দেখছিলেন প্রথমে, ট্রেনটা ছাড়তেই মাথা ঘোরালেন, -আর বল শান্তনু বাবু, কুণাল মেয়ের বিয়েতে কি তোমায় বলল?

তাতে আপনার কি? কথাটা বলতে গিয়েও গিলে নিল শান্তনু। জানলার দিক থেকে মুখ না ঘুরিয়েই বলল –বলেছে তো! আপনি ছিলেন না সামনে?

-আমি ঠিক খেয়াল করি নি। কি মনে হয়? টিকবে?

-কি টিকবে?

-না মানে, বামুনের মেয়ে! আর ছেলে তো শুনলে; ঘোষ!

-সত্যি গুণময়দা! হেসে মুখ ফেরাল শান্তনু।

-মানুষ কোথা থেকে কোথায় চলে গেল! আর আপনি বামুন; ঘোষ এইসব নিয়ে আজও রয়ে গেলেন! পারেন বটে আপনারা!

-কি বলছ? কম তো দেখলাম না। চুল সব সাদা হয়ে গেল হে!

আলোচনাটা মোটেও ভাল লাগছিল না শান্তনুর। কথাটা যেন কানেই যায়নি এমন ভান করে সে বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে রইল।

ঘড়ি-টা একবার আড়চোখে দেখল শান্তনু। ঠিক ছ’টা কুড়ি। এই সময় সে কত স্বপ্ন দেখে। কত মনগড়া চিন্তা। গুময় বাগচী তুমি আমার নিজের সন্ধ্যাটা মাটি করে এখন আমায় ঘোষ আর বামুনের সংসার দেখাচ্ছ! শালা মরন হয় না! রাগে দাঁত কিরমির করে উঠল শান্তনুর।

-যাই বল! তোমরা বেশ আরামে বাড়ি যাও। আমাদের যা ভিড় ঠেলতে হয় রোজ! এই সময় সংগ্রামপুর নামা কি চাট্টিখানি কথা।

-আপনি আগে বের হলেই তো পারেন! অফিস ছুঠির পর এই বয়সে চায়ের দোকানে বসে গল্পের ঝাপি না খুললে কি চলে না?

-কি বলছ হে! ওটা একটা নেশা। চাকরি করছি আজ ছত্রিশ বছর। সেই প্রথম দিন থেকে চলছে এই চা দোকানের কালচার। ও ছাড়া মানুষ বাঁচে না কি? আমি পান ছাড়তে পারি একদিন, কিন্তু ওটা ছাড়লে সেই দিনই জানবে আমার শেষ

শান্তনু উত্তর না দিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। পাশে তাসের আসর বেশ জমে উঠেছে। দুই দলের ইতিমধ্যেই বার তিনেক ঝগড়া হাতাহাতি হয়ে গিয়েছে।

ট্রেন বারুইপুরে ঢুকছে। এবার সিট ছেড়ে দিতে হবে। নিত্যযাত্রী এতক্ষণ যারা দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাদের বসবার সুযোগ করে দিতেই এই অলিখিত নিয়ম। বয়স্ক মানুষরা পার পেয়ে গেলেও শান্তনুর মতন যুবকরা প্রায় সবাই স্ব-ইচ্ছায় সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

এখানে এসে ট্রেনটা বেশ অনেকটা ফাঁকা হয়ে যায়। আবাব নতুন করে একদল যাত্রী উঠে আসে। শান্তনু জানলা দিয়ে তাদেরই ধাক্কাধাক্কি দেখছিল আর ভাবছিল গুণময় বাগচীকে যদি এইভাবে একটা ধাক্কা দেওয়া যায়, বুড়ো সামলাতে পারবে? মিনিট কয়েক পর ট্রেনটা আবার নড়ে উঠল। আজ যেন ভিড়টা একটু বেশী মনে হচ্ছে।

নতুন একটা পানের কাগজ খুলতে খুলতে গুময় বললেন, -আমি একটু পরেই এগিয়ে যাব ভায়া, তা নাহলে নামা খুব দুষ্কর হবে। তুমি আবার বসে পড়বে।

শান্তনু মনে মনে একটু ভেবে নিল। আজ এই বুড়ো তার সন্ধ্যাটা পুরো মাটি করে দিল। একে সহজে ছাড়া যাবে না। বদলা চাই।

-তাহলে জন্মদিনের পার্টিটা দেবেনই না!

-পরে একদিন খাইয়ে দোব তোমায়। মাস পয়লায়, কথা দিচ্ছি। হেসে বললেন গুণময় বাবু।

-আরে পরে কি হবে? যেদিন যা সেদিন তা!

-আজ থাক ভাই। অন্য কোন দিন। অনুনয় করেন গুণময়।

-আচ্ছা ছাড়ুন। ফাঁকিই দিলেন তবে! যার যা কপাল। মুচকি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিল শান্তনু।

বারুইপুর থেকে ওঠা পরিচিত একজন এসে দাঁড়িয়েছিল পিছনে। অন্যদিন তেমন কথা হয় না, হাসি বিনিময় ছাড়া। আজ গুণময়কে চটাবার জন্যই শান্তনু তার দিকে তাকিয়ে বলল,-বাবুর গিন্নির জন্মদিন। বেমালুম চেপে গেছেন, খাওয়ানোর ভয়ে; হা হা হা…

গুণময় চুপচাপ পান চিবোতে লাগলেন। তার মুখেও লাজুক হাসি।

শান্তনু এবার মরিয়া হয়ে শেষ কামড়টা দিল,-রিটায়ারমেন্টের পয়সা বাচাচ্ছেন আরকি! শুনেছি তো ছেলেপুলে কেউ নেই। কে খাবে দাদা?

গুণময়ের মুখ আমতানো থেমে গেল হঠাৎ। গালদুটো একটু লালচে হয়ে উঠল। শান্তনু বুঝল ওষুধ ধরেছে। দ্যাখ কেমন লাগে! আমার নিজস্ব সময়টা আজ গলা টিপে মেরেছিস ব্যাটা। বোঝ এবার ঠেলা!

গুণময় উঠে দাঁড়ালেন। মুখটা থমথমে। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে একটু টলে গিলে শান্তনুর কাঁধটা খামচে ধরলেন। তারপর মাথা তুলে বললেন,-আচ্ছা! তুমি জন্মদিনের পার্টি চাও তো! চল আমার বাড়ি।

শান্তনু একটু অপ্রস্তুত হল এবার। মাঝ রাস্তায় নামার ইচ্ছা তার একেবারেই নেই। সে হাসতে হাসতে বলল,-না না এমন জোর করে নেমন্তন্ন আমি নেব না। পরে একদিন হবে।

-না পরে কেন? মরিয়া হয়ে উঠলেন গুণময়,-পরে কি হবে! যেদিন যা সেদিন তা।

শান্তনু বিপাকে পড়লো। গুণময় স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন তার দিকে। সে কথা ঘোরাবার জন্য বলল,-আমি ঠাট্টা করছিলাম গুণময়দা। এমনি বলেছি। একটা ঢোক গিলল শান্তনু।

-না! আজই চল। যেতেই হবে। শান্তনুর হাত ধরে বললেন গুণময় বাগচী। তার কন্ঠ স্থির ও শান্ত।

অগত্যা! অনিচ্ছা স্বত্তেও শান্তনুকে ট্রেনের দম বন্ধ কার ভিড় ঠেলে নামতেই হল সংগ্রামপুরে। স্টেশনের বাইরে এসে একটা দোকান থেকে মাঝারি মাপের একটা কেক কিনলেন গুণময়। বেশ দামী কেক। শান্তনুর খুব অপ্রস্তুত লাগছিল। মাসের শেষে মানুষটার পিছনে না লাগলেই বোধহয় ভাল হত!

আরও টুকটাক কিছু খাবার-দাবার কিনে একটা রিকশা নিয়ে ওরা যখন গুণময় বাবুর বাড়ির সামনে এসে থামলো তখন আটটা বেজে গিয়েছে। শান্তনু আগে সংগ্রামপুরে এলেও এদিকটায় তার আসা হয় নি।

বেশ পুরনো দিনের বাড়ি। প্রশ্ন করে শান্তনু জানতে পারলো এটা গুণময় বাবুর বাবার তৈরী বাড়ি। বয়েস কম করে আশি বছর হবে। কড়া নাড়তে একজন মাঝ বয়েসি মহিলা এসে সদর দড়জা খুলে একপাশে সরে দাঁড়ালেন। শান্তনু বুঝলো ইনিই মিসেস গুণময় বাগচী।

সরু একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন প্যাসেজ চলে গেছে সামনের দিকে। কিছুটা গিয়ে একটা খোলা শান বাঁধানো উঠোন। ওপাশে দু’তিন ধাপ সিঁড়ি উঠে একটা চওড়া বারান্দা। তার পরে ঘরের দড়জা। বারান্দায় একটা কম পাওয়ারের এলইডি বাল্ব জ্বলছে। উঠোনটা তার আলোতেই সামান্য আলোকিত হয়ে রয়েছে। যদিও সেখানে অন্ধকারই বেশী।

গুণময় হাতের প্যাকেটগুলো ভদ্রমহিলাটিকে দিয়ে উঠোনের এক পাশের ছোট একটা চৌবাচ্চার দিকে এগিয়ে গেলেন। চোখের ইশারায় শান্তনুকেও ডাকলেন।

হাত-পা ধুয়ে ওরা ভিতরের ঘরে এল। সামনের সোফাটার উপর অনেক জামা কাপড় ডাঁই করে রাখা। টেবিলে খবরের কাগজের স্তুপ। মাটিতেও ইতি-উতি গড়াচ্ছে তাদের কয়েকটা। শান্তনু এক ঝলক দেখেই বুঝলো বাগচী গৃহিণী তেমন একটা গোছানো নন। কাপড় জামাগুলো ঠেলে একপাশে সরিয়ে গুণময় বললেন,-বোস শান্তনু। তোমার অনেক দেরী করে দিলাম আজ।

-আরে না না! আমিই তো আপনাকে ঝামেলার মধ্যে ফেললাম গুণময়দা! একটু লজ্জা পেল শান্তনু।

-বোস বোস! এখানে ভোল্টেজটা সন্ধ্যার পর একটু কম। পাখা যেন ঘুরতেই চায় না। একটু কষ্ট করেই থাক।

-কি যে বলেন দাদা! শান্তনু সোফার একপাশে বসতে বসতে বলে।

কিছুক্ষণ পরেই চা চলে এল। চায়ের কাপটা নিতে নিতে শান্তনু আলতো একটু হাসলো ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে।

গায়ের শার্টটা খুলতে খুলতে গুণময় বললেন,-তুই যা নন্দা। বৌদিমনি কি করছে দেখ! বল একজন গেস্ট এসেছে। দেখা করবে।

ভদ্রমহিলা গভীর দৃষ্টিতে গুণময়ের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে চলে গেলেন।

হোঁচট খেল শান্তনু। ইনি তাহলে বাগচী ঘরনী নন! দেখে তো তাই মনে হচ্ছিল এতক্ষণ। বিরাট ভুল হয়ে যাচ্ছিল এক্ষুণি। তাকে বৌদি বলে ডাকেত যাচ্ছিল সে! পরকীয়ার গন্ধ আছে না কি? মনে মনে হাসে শান্তনু। নিজেকে সামলে চায়ের কাপে চুমুক দিল সে।

গুণময় গায়ের জামা খুলে দড়িতে টাঙানো একটা গামছা দিয়ে গায়ের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,-আমার বাড়িতে কাজ করে নন্দা। সারাদিন তোমার বৌদির দেখাশুনা, রান্না, ঘর পরিষ্কার সবই ওর দায়িত্বে।

-কেন? প্রশ্নটা করে থেমে গেল শান্তনু। মিসেস বাগচী কি তাহলে অসুস্থ? হবেও বা!

চা শেষ করে শান্তনু ইতস্তত করতে লাগলো। আর কতক্ষণ লাগবে কে জানে! বাড়ি ফিরতে আজ অনেক রাত হয়ে যাবে। একটু বাজার করার দরকার ছিল, সেটাও আজ আর হবে বলে মনে হয় না।

ওর অস্থিরতা দেখে এক গাল হেসে গুণময় বললেন,-দেরী হয়ে যাচ্ছে তোমার! তাই না?

-হ্যাঁ চলুন বৌদিকে উইশ করে কেকটা কেটে আমিও কেটে পড়ি। তারপর আপনারা ক্যান্ডেল লাইট ডিনার-টিনার করবেন। শান্তনু মজা করার চেষ্টা করে।

-এস তবে! কাজটা সেরেই নাও। আর দেরী করাবো না তোমার, রাত বাড়ছে।

ওরা বসার ঘরের ডানদিকের দড়জা দিয়ে আর একটা ঘরে এসে ঢুকল। এটা একটা শোওয়ার ঘরে। ঘরটা প্রায় অন্ধকার। একটা নীলচে আলো জ্বলছে ঘরের এক কোণে। জানলা সব বন্ধ। ঘরময় একটা মিষ্টি সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে।

দড়জার পাশে হাত নিয়ে ঘরের আলো জ্বালালেন গুণময়। বিছানাটা ঠিক ঘরের মাঝখানে। পরিপাটি করে চাদর পাতা। মাথার উপর পুরনো দিনের পাখা হালকা ঘুরছে। চাদরের কোণাগুলো সেই হাওয়ায় মৃদু মৃদু দুলছে।

গুনময় শান্তনুকে নিয়ে গেলেন ঘরের শেষ প্রান্তের দেওয়ালের দিকে। সেখানে ছোট একটা শোকেস রাখা রয়েছে। তার উপর পাশাপাশি দু’টো ফটো। চন্দনের ফোঁটা আর রজনীগন্ধার মালায় সাজানো। পাশে ধুপ জ্বলছে তার হালকা আবেশ ছড়িয়ে। সুন্দর গন্ধটা এই ধুপ আর মালা মিশিয়েই ঘরটাকে জড়িয়ে রেখেছে।

শান্তনু অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছে গুণময়ের দিকে, আর গুণময় সেই ছবি দুটোর দিকে। তার চোখ সামান্য চিকচিক করছে।

নন্দা একটু আগে কেনা কেকটা নিয়ে ঘরে ঢুকল। শোকেসের সামনে সেটা রেখে একটা মোমবাতি জ্বেলে দিল।

গুণময় হাত তুলে বললেন,-মিট মাই ওয়াইফ সুছন্দা বাগচী।

শান্তনু কি বলবে বুঝতে পারল না। স্তম্ভিত হয়ে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে একপাশে। গুণময় কেকের পাশ থেকে ছুরিটা তুলে নিলেন।

-পাশে যাকে দেখছ, সে আমার পুত্র শ্রীমান সৌরভ বাগচী। ২০১১ -র সংগ্রামপুর মনে আছে শান্তনু?

শান্তনুর মাথা ঝিমঝিম করছে। কোন মতে সে বলল,-চোলাই মদের বিষক্রিয়া...

তাকে থামিয়ে মাঝ পথে গুণময় বললেন,-ইয়েস! সেই ভয়ঙ্কর শীতের রাত। ছেলেটাকে অনেক বুঝিয়েও মানুষ করতে পারিনি শান্তনু। কোন অভাব রাখিনি কোনদিন তাও… বাজে সঙ্গে পড়ে… মাঝ রাতে হঠাৎ বমি করতে করতে বাইরের উঠোনে গিয়ে পড়লো। ওর মা উঠে আমাকে ঠলে তুলতে চাইল। আমি জেদ ধরে শুয়ে রইলাম। অনেক কাকুতি-মিনতি করল। আমি মুখ ঘুরিয়েও দেখলাম না।

ছেলে তখন সারা শরীরে খিঁচুনি ধরে থর-থর করে কাঁপছে। সুছন্দা আমার পায়ে এসে পড়ল, ছেলেটা যে মরে যাবে গো! বললাম, অমন ছেলের মরে যাওয়াই ভাল। মরেই গেল শেষটায়। চোখ বন্ধ করলেন গুনময়।

কয়েক মিনিট সব চুপচাপ। গুণময় আবার বললেন,-সুছন্দা শোকটা নিতে পারলো না। ঐ ঘটনার পর আর এক বছর ছিল। তাও বিছানার সাথে লেপ্টে।

এই ঘটনার এক বছর পর ধর্মতলা ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার নিলাম ইচ্ছা করেই। সবাইকে বললাম, আমরা নিঃসন্তান। কর্তা গিন্নি থাকি। কাউকে কোনদিন বাড়িতে ডাকিনি শান্তনু। ডাকতে পারি নি। এত বছর পর আজ তুমি প্রথম আমার অতিথি।

শান্তনু স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। এ কোন গুণময়দা! যে সারাদিন হাসি ঠাট্টা করে অফিস জমিয়ে রাখে, যে চায়ের দোকানে রাজনীতি থেকে খেলাধুলা সব বিষয়ে জ্ঞান দেয়। সে তো অন্য কেউ। শান্তনুর চোখদুটো জ্বালা করছে যেন! জল আসবে না কি?

কেকটা কাটা হয়ে গিয়েছে। গুণময় একটা টুকরো তুলে শান্তনুর মুখে সামনে ধরলেন। শান্তনু বাচ্চা ছেলের মতন সেটা খেয়ে নিল। গলা ভারি হয়ে আসছে। দলা পাকিয়ে উঠছে কান্না।

গুনময় একটা হাত শান্তনুর কাধে রেখে বললেন,-এই দিনটা একটু তাড়াতাড়ি আসি ভাই। সারা বছর তোমাদের জন্য গুণময় বাগচী তো রয়েছেই। এই একটা দিন ওদের জন্য সন্ধ্যাটা রাখি।

গুণময়ের চোখে জল। কেকের বাক্সের মুখটা বন্ধ করে দিয়ে বললেন,-এটা তুমি নিয়ে যাও শান্তনু। বাড়ি গিয়ে বৌমা আর মেয়েকে দিও। আমার ভাল লাগবে।

-কিন্তু! ইতস্তত করে শান্তনু।

গুণময় তার হাতদুটো চেপে ধরে বলেন,-প্লিজ! না বলো না! আজকের সন্ধ্যার কথাটা আর কাউকে না হয় নাই বললে! আর আট মাস চাকরি আছে, লোকের জিজ্ঞাসু চাহনি আমার সহ্য হবে না। সব যেমন চলছে চলুক না!

শান্তনু কথা না বলে কেকের বাক্সের হাতে নিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। আজকের এই সন্ধ্যার মতন সময় সে বোধহয় আর কখনও কাটায়নি।

-তোমাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি ভাই। বা বলতে পার সত্যি চেপে গিয়েছি।

-সে কি! অবাক চোখে তাকালো শান্তনু।

গুণময় কাঁধের গামছাটা দিয়ে চোখ মুছে বললেন,-আজ আমার গিন্নির সাথে সাথে ছেলেটারও জন্মদিন। ঐটা তোমাকে আমি বলিনি। ম্লান হাসলেন গুনময় বাগচী।

-- সমাপ্ত --

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

ছুটি

প্রতিশোধ

পরশ পাথর