দেবদেউলের সর্বভূক
এক
ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই ওরা বেড়িয়েছিল। লক্ষ্য ছিল সাত মাইল
দূরের দেবদেউল পাহাড়।
ওরা চারজন। শৈবাল, অমৃত, বিকাশ আর জয়ন্ত। প্রতিবারই পূজোর ছুটিতে
ওরা বেড়িয়ে পড়ে। জয়ন্তর ভাষায়, কলকাতার পূজোর ভিড় এককথায় অসহ্য। মেয়েগুলোর মাত্রাছাড়া
মেক-আপ আর আগ বাড়িয়ে গায়ে পড়া। তারচেয়ে দূরে কোথাও, নির্জন কোন স্থানে এই সময়টা কাটানো
অনেক আরামদায়ক। বাকিরাও তার সাথে একমত। তাই প্রতি বছর তারা এই সময়টায় খুঁজে নেয় কোন
একটা নিরিবিলি জায়গা। যেখানে নিজেদের মতন এ্যাডভেঞ্চার করে কয়েকটা দিন কাটানো যায়।
এবছর কোথায় যাওয়া হবে তা নিয়ে একটা তর্ক প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল। শৈবাল আর বিকাশ
ছিল গভীর জঙ্গলের পক্ষে, আর অমৃত জয়ন্ত পাহাড়ের। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে
শেষে পাওয়া গেল এই জায়গাটার খোঁজ। এখানে পাহাড় জঙ্গল দুই আছে।
এর আগে দু-একবার এইভাবে অজানা জায়গায় গিয়ে ওরা ঠকেছে। তথ্য যা বলেছিল
বাস্তবে তার সাথে বিন্দুমাত্র মিল পায়নি। একটা সংশয় তাই ছিল। কিন্তু এখানে পৌছে ওদের
সব সন্দেহ নিমেশে মিলিয়ে গেছে জঙ্গলী বাতাসে। জায়গাটা তারা যতটা ভেবেছিল তার চাইতেও
বেশী নির্জন এবং অস্বাভাবিক শান্ত।
গতকাল বিকালে ওরা এসে পৌছেছে এখানে। বন বিভাগের বাংলোয় আগেই বুকিং
করা ছিল। ছোট্ট বাংলো বাড়িটাতে সর্ব সাকুল্যে মাঝারি মাপের চারটে ঘর। দেখাশুনা করার
জন্য রহমত বলে এক পৌঢ় আছেন। তিনিও একাই থাকেন। এখানে বড় একটা কেউ আসে না বন বিভাগের
কর্ত্তারা ছাড়া। তাই রহমত প্রথমটা ওদের দেখে খুব অবাকই হয়েছিল। একটু সামলে বাংলোর
দুটি ঘর দখল করে নিল ওরা।
সন্ধ্যার পর এই অঞ্চলে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। মোমবাতি আর হ্যাজাক
বাতি ভরসা। ছোট জেনারেটর একটা আছে বটে, তবে সেটা অফিসার গোছের কেউ না এলে চালানো
কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। নিজেদের ব্যাগ পত্তর ঘরে রেখে ওরা যখন একটু হালকা হয়ে নিল তখন
সন্ধ্যা গড়িয়ে গিয়েছে।
টানা বারান্দা সোজা চলে গেছে। তার একপাশে কাঠের রেলিং আর অন্যদিকে
পর পর চারটে ঘর। ফ্রেশ হয়ে ওরা বারান্দায় এসে জড়ো হল একে একে। রহমত আগেই একটা হ্যাজাক
রেখে গেছে। এবার চা নিয়ে এল ট্রেতে করে।
জয়ন্ত –আহঃ! এটাই দরকার ছিল রহমত চাচা। বলে সবার আগে প্রায় লাফিয়ে
উঠে চায়ের কাপ তুলে নিল। দিনে অন্তত দশ কাপ চা আর তিন প্যাকেট সিগারেট না হলে তার চলে
না।
ট্রেটা টেবিলে রাখতে রাখতে রহমত বলল,-আজ রাতে বাবুরা শুধু খিচুড়ি
আর ডিম ভাজা পেতে পারেন। কাল সকালে বাজারে গিয়ে যা ফরমায়েশ করবেন নিয়ে আসব।
অমৃত চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,-তোমাদের সিস্টেমটা ভারি অদ্ভুত রহমত!
আমাদের বুকিং ছিল অথচ কেউ এখানে খবর পাঠায়নি।
-আজ্ঞে খবর আসেতো! ফোন করে জানিয়ে দেয় আমাকে। আসলে আমার ফোনটা
কয়েকদিন হল খারাপ। শহরে যাওয়া হচ্ছেনা কদিন, তাই….
-ও! আর আমরাও কোন ফরেস্ট অফিসার নই যে খবর দিতেই হবে। তাইতো?
ঠিক আছে আজ খিচুড়িই হোক। কি বলিস তোরা? শৈবাল জানতে চাইল সবার কাছে।
-আর কোন অপশন যখন নেই… হোক!
-কাল কি খাবেন বলে দিন। আমি সকালেই বাজারে গিয়ে নিয়ে আসব। রহমত
একটু অপ্রস্তুতভাবেই বলল।
-বাজার কত দূর রহমত?
-এখান থেকে চার মাইল।
-মুরগি পাওয়া যায় ভালো? একটা সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে
বলল জয়ন্ত।
-ছাড় তো খাওয়ার কথা। বিরক্ত হয় বিকাশ। -এখানে কি বসে খেতে এসেছিস
না কি! যেটা চাই, সেটা হল থ্রিল। রহমত তুমি যা খাওয়াবে আমরা তাই খাব। এখন বলোতো এখানে
দেখার কি আছে?
-জঙ্গল তো দেখছেনই বাবু! কিছুটা দূরে একটা পাহাড় আছে। দেবদেউল
পাহাড়। আসতে গিয়ে দূর থেকে চোখে পড়েছে নিশ্চই!
-হ্যা! তা তো পড়েছেই। আমি বলছি এছাড়া আর কি আছে?
-আর কয়েকটা ঝর্ণা আছে। পাহাড়ের মাথায় একটা অন্ধকার গুহায় চন্ডী
মন্দির আছে। আর পাহাড়ের ঐ পাশে আছে কাল ভৈরব মন্দির আর হাড়গিলে শ্মশান।
-হাড়গিলে শ্মশান। অবাক হয়ে তাকালো ওরা চারজন। -এই গভীর জঙ্গলে
শ্মশান! তার আবার এমন উদ্ভট নাম!
-হ্যা! আগে অনেক হাড়গিলে পাখি থাকতো ঐ জায়গাটায়। শ্মশানের মড়া
খেয়েই বেঁচে থাকতো। এখন অবশ্য আর নেই। সেই থেকেই নাম হয়েছে হাড়গিলে শ্মশান।
-যাওয়া যায়? আড়মোড়া ভেঙে প্রশ্নটা করলো অমৃত।
রহমত উত্তর না দিয়ে কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
তারপর বলল,-না যাওয়াই ভালো বাবুরা। জায়গাটা তেমন সুবিধার নয়। আর খুবই দুর্গম। তার
চেয়ে কাল পাহাড়ের এপাশটা ঘুরে আসুন। বাংলোর উত্তরদিকে সরু একটা পথ রয়েছে। জায়গায় জায়গায়
দেখবেন সইনবোর্ডও দেওয়া আছে সুবিধার জন্য। ওটা ধরে এগোলেই পৌছে যাবেন বাবুরা।
-হু! আর কোন উত্তর দেয়নি ওরা কেউ। নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়া-চাওয়ি
করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল।
রাতেই প্ল্যান তৈরী হয়ে গেল। মাত্র চারদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে ওরা।
সময় হাতে কম। কাজেই সেটা নষ্ট করার কোন মানে হয় না। কালই তারা যাবে হাড়গিলে শ্মশান
আর কাল ভৈরব মন্দির। চার এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বন্ধু তাড়াতাড়ি গরম গরম খিচুড়ি আর ডিম
ভাজা খেয়ে শুয়ে পড়ল।
দুই
দেবদেউল পাহাড়ের নীচে ওরা যখন পৌছালো তখন বেলা প্রায় দশটা। সাত
মাইল পথ আসতেই ওদের প্রায় পাঁচ ঘন্টা লেগে গেল। দুপাশে ঘন জঙ্গল। মাঝখানে পায়ে চলা
পথ। যদিও এ পথে সচরাচর কেউ আসে বলে মনে হয় না। মাঝে দুটো সরু নদীখাত পেরোতে হয়েছে।
তাদের নাম যদিও জানেনা ওরা। বাংলো ছেড়ে কিছুটা এগিয়েই উচু নীচু পাহাড়ি পথ শুরু হয়েছিল।
দেবদেউল পাহাড়ের যত কাছে ওরা যেতে লাগলো পথও ততই রুক্ষ হয়ে উঠতে শুরু করলো।
পাহাড়ে ওঠার জন্য ধাপে ধাপে এবড়োখেবড়ো পাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে
উপরের দিকে। ওরা চারজন এবার একটু থামলো।
জয়ন্ত একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল,-ও! সত্যি মাইরি! এবারের আসাটা সার্থক।
অমৃত তোরই ক্রেডিটটা পুরো পাওনা। তুই নেটে খুঁজে খুঁজে সত্যি দারুন একটা জায়গা বের
করেছিলিস। থ্যাঙ্কস গুরু।
শৈবাল একটু দূরে একটা গাছের গায়ে প্রাকৃতিক কাজ সারছিল। প্যান্টের
চেইনটা টানতে টানতে ফিরে এল। অমৃত একটা বড় পাথরের উপর শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে।
বিকাশ সঙ্গে আনা ফ্লাস্ক থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল,-এতটা পথ
এলাম, কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করেছিস?
-কি রে? শৈবাল কাছে এসে বলল।
-এই অঞ্চলে কোন পশু চোখে পড়ছে না। এমনকি ভালো করে খেয়াল কর পাখির
ডাকও প্রায় শোনাই যায় না।
সবাই কান খাড়া করল। জয়ন্ত বলল,-না না! পাখির ডাক শোনা যাচ্ছেতো
মাঝে মাঝে। পশু হয়তো পাহাড়ি জায়গা বলে তেমন একটা নেই।
-কে জানে! বিকাশ চায়ের কাপ আর বিস্কুটের প্যাকেট এগিয়ে দিল সবার
দিকে।
আরও মিনিট কুড়ি জিরিয়ে নিয়ে ওরা পাহাড়ে ওঠা শুরু করল। দুপাশে বড়
বড় গাছ। ভাঙাচোড়া সিঁড়িগুলো বেশ খাড়া আর সরু। ওরা সবাই একজনের পিছনে আর একজন করে
উঠতে লাগলো দেবদউলের চুড়ার দিকে। কোথাও কোথাও পাথরের ধাপ গুলোর অবস্থা এতই খারাপ
যে পা পিছলে পড়তে পড়তে বাঁচলো কয়েকবার।
ওরা অনেকটা উঠে এসেছে তখন। সকলেই মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখছিল বাকিরা
ঠিক আছে কি না!
বিকাশ ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,-সত্যিকারের এ্যাডভেঞ্চার বস্! কোন কথা হবে
না।
-যা বলেছিস! সায় দিল জয়ন্ত। তারপর দূরে দৃষ্টি প্রসারিত করে বলল,-ওধারে
আর একটা পাহাড় রয়েছে দেখেছিস?
শৈবাল ছিল সবার পিছনে। সে হাঁটা থামিয়ে বলল,-এবার একটু বস মাইরি!
আর পারছিনা।
-সেকি গুরু! হাওয়া বেরিয়ে গেল? এর মধ্যেই? সবাই হেসে উঠলো একসাথে।
এতটা চওড়া মতন চাতালে এসে সবাই দাড়ালো। একপাশে খাড়া পাহাড়, অন্য
পাশে গভীর খাদ।
শৈবাল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,-কত সিঁড়ি হবে বলতো। আর কত উঠতে হবে?
জয়ন্ত পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলল,-৩৭০০ সিঁড়ি দাদা।
এটলিস্ট নেট-এ তো তাই দেখেছি।
-ও বাবা! হাফ রাস্তা কি এসেছি? নাকি তাও না?
অমৃত একটু এগিয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল,-সামনে পথ দুটো ভাগে ভাগ
হয়ে গেছে। একটা উপর দিকে চলে গেছে, আর একটা নীচে।
অবাক হয়ে তাকালো সবাই। বিকাশ বলল,-আমরা উপরের দিকেই যাবতো?
-এদিকে পেটে যে ছুচো কুই কুই করতে লেগেছে ব্রাদার। শৈবাল বলল।
-তাছাড়া আমি সত্যিই ক্লান্ত। আজ ক্ষেমা দে। কাল আবার আসবো। এবার না হয় সাথে খাবার
দাবার কিছু প্যাক করে আনা যাবে। কি বলিস তোরা?
শৈবল সুগারের পেশেন্ট ওরা জানে। কাজেই ওর কথা চিন্তা করে সবাই নিমরাজি
হল ফিরে যেতে। জয়ন্ত বলল,-অগত্যা! কিন্তু কাল আবার এতটা পথ ফিরে আসবো? হাড়গিলে শ্মশানেই
বা কবে যাবো তবে?
-আরে হবে হবে! আরও তিনটে দিন আছেতো হাতে! সকলকে আশ্বস্ত করে শৈবাল।
-তাহলে চল সামনে যে পথটা নীচের দিকে নেমে গেছে সেইটে দিয়েই নেমে
যাওয়া হোক। অমৃত একটু মনক্ষুন্ন হয়েই বলল। তার আদৌ ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না এখন।
বিকাশ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বেলা নেহাত কম হয়নি। দুপুর দু’টো
বাজে প্রায়। চা, বিস্কুট, চিপস্ যা এনেছিল সব শেষ অনেকক্ষণ। আরও কিছু খাবার সাথে আনা
উচিত ছিল তাদের। এটা নেহাতই ছেলেমানুষী হয়ে গেছে। মাথা ঝাকিয়ে সে বলল,-চল ফিরেই যাই
আজ। আমারও কিন্তু বেশ ক্ষিদে পাচ্ছে।
আর একটু উপরের দিকে উঠেই পথটা দুটো ভাগ হয়ে গেছে। নীচের দিকের
পথটা ধরে ওরা চারজন নামতে শুরু করল। ক্ষিদেও একরকম ছোঁয়াচে রোগ। বিশেষ করে এই দুপুরের
সময়। একে একে সবারই পেট চুই চুই করতে শুরু করেছে ততক্ষণে।
তিন
বেশ কিছুটা নেমে আসার পর ওরা বুঝতে পারলো এই পথটা আগের থেকে অনেক
বেশী দুর্গম। এখানে পাথরগুলো অনেক খাড়া। কিছু কিছু জায়গায় এত বেশী খাড়া আর পিছল যে
ওদের রিতিমত কসরত করে ঘষটে নামতে হচ্ছিল। এখানে দুদিকেই সোজা পাহাড়ি দেওয়াল উঠে গেছে।
এই পথটা পাহাড়ের গা বেয়ে নয়, পাহাড়টাকে মাঝখান দিয়ে চিড়ে নেমে গেছে।
আরও কিছুটা নামার পর জায়গায় জায়গায় জমা জল দেখা গেল। বেশ অনেকদিক
আগের জমা জল, কারণ দুর্গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছে সেই জল থেকে। আশেপাশের পাথরগুলোও শ্যাওলা
পড়ে সবুজ হয়ে রয়েছে।
বিকাশ হঠাৎ কিছুটা সন্দেহের স্বরে বলল,-এটা বোধহয় আগে কোন নালা
বা ঝর্ণা ছিল। কিংবা পাহাড়ি কোন নদী। এখন শুকিয়ে গিয়ে পথের মতন মনে হচ্ছে। ঠিক যাচ্ছিতো
আমরা?
খটকা সবার মনেই কম বেশী লেগেছে। সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল একপাশে। ফেলে
আসা পথের দিকে মাথা উচু করে তাকিয়ে জয়ন্ত বলল,-ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় এই পথে। কতটা খাড়া
দেখেছিস!
শৈবাল পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বলল,-অমৃতর কথায় এই পথে আসাটাই ভুল
হয়েছে। চেনা পথে ফিরে গেলেই ভাল হত।
অমৃত মুখ ভেঙচে বলল,-আমি মাথার দিব্যি দিয়েছিলাম নাকি শালা!
-তুইই তো বললি এই পথে নামা হবে। সিওর না হয়ে কিছু বলিস কেন?
-আহঃ! তোরা চুপ কর। জয়ন্ত বিরক্ত হয়ে হাত ঝাড়লো। -যদি নালা বা
ঝর্ণাও হয়ে থাকে নীচে ঠিকই যাবে। মাঝ রাস্তায় তো আর ভ্যানিস করে যাবে না। চল কথা না
বাড়িয়ে এগিয়ে যাই।
একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে ওরা আবার নামতে শুরু করল। অমৃত সবার
আগে যাচ্ছিল। রাগে নিজের মনে গজ গজ করতে করতে কিছুটা বেপরোয়াভাবে সে নামতে শুরু করলো।
পথ এখন কিছুটা সমতল। কিন্তু বিশাল বিশাল চেহারার পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পথ জুড়ে।
সেগুলোকে টপকে যেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ওদের। কিছু জায়গার জল এমন বিচ্ছিরি ভাবে পথ
আটকে রেখেছে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্যান্ট ভিজে যাচ্ছে।
আরও প্রায় ঘন্টাখানেক নিঃশব্দে নেমে চলল সকলে। পথ যেন আর শেষই হয়
না। চারপাশের দৃশ্য এর মধ্যে অনেকটা পালটেছে। স্থানে স্থানে পাথরের গায়ে আবির বা সিঁদুর
জাতীয় কিছু লেপা দেখা যাচ্ছিল বেশ কিছুক্ষণ ধরে। যেন কেউ সেগুলোকে পূজো করে গিয়েছে।
এবার কিছু কিছু পাথরের আশেপাশে ছোট বড় জন্তুর হাড় দেখা গেল ছড়িয়ে রয়েছে। জমিটাও অনেক
চওড়া হয়ে গেছে এখন। পাথরের নিরেট দেওয়ালগুলো অনেকটা দূ্রে সরে গেছে। বড় বড় গাছ চারদিক
ঘিরে রয়েছে। তবে কি ওরা একদম সমতলে নেমে এসেছে?
হাঁপাতে হাঁপাতে অমৃতই প্রথম কথা বলল,-নীচে চলে এসেছি মনে হচ্ছে।
যা শালা আমার ডিউটি শেষ। কথাগুলো বলে সে পিছন ফিরলো। কিছুটা দূরে জয়ন্তকে দেখা যাচ্ছে।
বিকাশ আর শৈবাল এখনো চোখের আড়ালে। ওকে দেখে জয়ন্ত একবার হাত তুলে দাঁড়াতে বললো।
একটা বড় পাথরে পিঠ ঠেকিয়ে দু হাত দুপাশে ছড়িয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিল অমৃত। রাগে তার মাথার
শিরা এখনও দপ দপ করছে। জয়ন্ত কাছে চলে এসেছে। বিকাশকেও দেখা যাচ্ছে এবার।
জয়ন্তও পাথরের গায়ে হেলান দিল এসে। সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে
পকেট হাতড়ে দেশলাইটা খুঁজতে লাগলো। অমৃত মাথা ঝাকিয়ে বলল,-শৈবলের সাথে এবার থেকে কোন
ট্যুর করলে আমাকে বাদ দিয়েই চিন্তাভাবনা করিস।
-ছাড় না! জয়ন্ত বিরক্ত হয়। -যেতে দে!
-তোরা তো এ্যাডভেঞ্চার করতেই এসেছিলিস। এটা কি কম রোমাঞ্চকর
অভিজ্ঞতা হল বল!
-তা বটে। দেশলাইটা খুঁজতে খুঁজতে অধৈয্য হয়ে উঠল জয়ন্ত। -কোথায়
যে রাখলাম! নিজের মনেই সে বলল।
বিকাশ পৌছে গেছে ওদের কাছে। দুহাত কোমড়ে রেখে সামনে পিছনে শরীরটাকে
ঝুকিয়ে বিকাশ বলল,-যা হল না মাইরি! আমাদের আগের সব এ্যাডভেঞ্চার এর সামনে নস্যি। মনে
থাকবে।
জয়ন্ত দেশলাইটা খুঁজে চলেছে সমানে। বিকাশ বলল,-কি খুঁজছিস এমন করে?
-আরে দেশলাইটা কোথায় যে রাখলাম! আহঃ! ভালো লাগে না।
-তুই এবার সিগারেটটা ছাড়। অমৃত বললো।
কথার উত্তর না দিয়ে জয়ন্ত দূরে তাকিয়ে বলল,-শৈবালটা গেল কোথায়?
এদিকে আকাশ কেমন মেঘলা হতে শুরু করেছে দেখ! আবার বৃষ্টি না নামে এর মধ্যে।
ওর কথায় সবাই শৈবালের আসার পথের দিকে তাকালো। শৈবালের চিহ্ন মাত্র
নেই।
-এত সময় লাগে নাকি! আমার পিছনে পিছনে তো আসছিল। ভ্রু কুঁচকে বলল
বিকাশ।
-পথে আবার শরীর খারাপ করলো নাতো! অমৃতও চিন্তিত হয়ে উঠলো এবার।
আকাশ ক্রমশ কালো হতে শুরু করেছে। জমাট বাধা মেঘ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
মাথা তুলে সেদিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল বিকাশ।
-দেখ দেখ! ওগুলো কি পাখি রে?
অনেক উচুতে কয়েকটা পাখি চক্রাকারে উড়ে বেড়াচ্ছে। এতটা পথে কোন
পাখিই তো চোখে পড়েনি! জয়ন্ত আর অমৃতও তাকালো উপরের দিকে।
-এগুলো তো হাড়গিলে মনে হচ্ছে। বলল অমৃত।
-হাড়গিলে!
-হ্যা! আই এ্যাম সিওর।
ওরা একে অপরের দিকে তাকালো। আশেপাশে একটা বোঁটকা দুর্গন্ধ অনেকক্ষণ
থেকেই নাকে এসে লাগছিলো। এবার সেটা যেন আরও কাছে এগিয়ে এল।
-বুঝেছি। এটা হাড়গিলে শ্মশান। আমরা সেখানেই এসে পড়েছি। কাঁপা গলায়
বলল জয়ন্ত। দেশলাই খুঁজতে সে ভুলে গেল।
-শৈবালকে দেখতে হবে আগে। বিকাশ গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
-রহমত বলেছিল জায়গাটা সেফ নয়।
চার
ঘড়ির কাঁটা বিকাল সাড়ে চারটে পেরিয়ে গেছে। আলো ক্রমশ কমে আসছে।
পাহাড়ে এমনিতেই ঝুপ করে অন্ধকার নামে। আর এখানে তো দুদিকেই উঁচু পাথুরে দেওয়াল। এর
মধ্যেই শুরু হয়েছে অবিরাম ঝিঁঝিঁর ডাক। অসহ্য একটানা কানে জ্বালা ধরিয়ে দেওয়া সে ডাক।
তার সাথে রয়েছে একটা তীব্র কটু গন্ধ। বিকাশ কোন মতে উপরের দিকে কিছুটা পথ গিয়ে আবার
ফিরে এসেছে। শৈবালের কোন চিহ্ন কোথাও নেই। এদিকে নেটওয়ার্ক নেই বলে মোবাইলগুলোও
কেউ সঙ্গে আনেনি। তিনজন অনেকক্ষণ শৈবালের নাম ধরে ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে আবার একটা
চওড়া পাথরের উপর গোল হয়ে বসে পড়লো।
-তুই শেষ ওকে কখন দেখেছিস বিকাশ? আনমনে প্রশ্ন করে অমৃত।
-তাও অনেকক্ষণ। আমার পিছনেই ছিল। একবার চেঁচিয়ে বলল, তুই এগো আমি
একটু হালকা হয়ে আসছি।
-তুই আর দাঁড়াসনি! তাইতো?
-না! আমি ভাবলাম কাজ সেরে ঠিকই চলে আসবে। পথতো একটাই। তাই….
-হুম! চুপ করলো অমৃত। এই প্রথম তার খারাপ লাগছে। নিজেকে দোষী
মনে হচ্ছে। না এলেই বোধহয় ভালো হত এই পথে।
-কি করবি এখন? জয়ন্ত প্রশ্ন করলো।
-কি করতে পারি আমরা। এই পথে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। সামনের দিকেই যেতে
হবে আমাদের। কিন্তু তার আগে জানা দরকার শৈবালের কি হল?
-কোথাও অজ্ঞান হয়ে পড়েনি তো? হয়ত ক্ষিদের জ্বালায় বা অন্য কোন
কারণে।
-এদিকে অন্ধকার হয়ে এল প্রায়। এরপর কিছুই আর দেখা যাবে না। সঙ্গে
টর্চ আছে বটে, কিন্তু তার উপর কতক্ষণ ভরসা করা যাবে?
-আমার মনে হয় ফিরে গিয়ে রহমতকে জানিয়ে আরও লোক নিয়ে আমাদের ফিরে
আসা উচিত। বাকি দু’জনের মুখের দিকে তাকালো জয়ন্ত।
কারও মুখে কোন উত্তর নেই। জয়ন্ত আবার বলল,-কি করবি? তাছাড়া এভাবে
বসে থেকে তো কোন লাভ হবে না বল! প্লিজ ডু সামথিং!
অমৃত উঠে দাঁড়ালো। ঝাঁঝাঁলো গলায় বললো,-দোষটা যখন আমার, তখন
আমিই দেখি!
-দোষ গুণের কথা হচ্ছে না অমৃত। তুই গায়ে নিচ্ছিস কেন? ওভার রিয়্যাক্ট
করিস না। এটা ঠান্ডা মাথায় একটা ডিসিশন নেওয়ার সময়।
-আমি এই পথে না আনলে তো কিছুই হত না। এতক্ষণে দিব্যি বাংলোয় বসে
বিশ্রাম করতিস তোরা ইনক্লুডিং শৈবাল।
-যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। এখন আর ওটা নিয়ে ভেবে কোন লাভ নেই। কি
হতে পারে সেটা ভাবাই সঠিক কাজ এখন। এটা যে একদম সমতল নয় তা বুঝতেই পারছিস। আমরা কতটা
উপরে আছি তাও সঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বিকাশ বলল,-জয়ন্ত ঠিকই বলেছে, আমাদের ফিরে
গিয়ে রহমতকে জানানো উচিত। ও লোকাল লোক। আমাদের থেকে অনেক ভালো চিনবে দেবদেউলকে।
তিনজন একমত হয়ে আবার নীচের দিকে নামতে শুরু করল। জয়ন্ত ব্যাগ থেকে
টর্চ বের করে নিয়েছে হাতে। ঘন গাছপালা আর পাথরের জন্য সামনের পথ প্রায় অন্ধকার। যদিও
আকাশে এখনও আলো দেখা যাচ্ছে।
সবার আগে হাঁটছিল জয়ন্ত। হাতের পাঁচ সেলের টর্চের তীব্র আলো ফেলছিল
সামনের দিকে। পিছনে অমৃত আর বিকাশ প্রায় গায়ে গায়ে আসছে। কিছুটা আসার পর জয়ন্ত থেমে
গেল। তার পিছনে ওরা দুজনও। সামনে নিরেট পাথরের দেওয়াল সোজা উঠে গেছে। পথ এখানেই শেষ।
বিকাশ অমৃতর হাত সজোরে চেপে ধরলো। অমৃতও অবাক চোখে চেয়ে আছে
পাথরের দেওয়ালটার দিকে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
উল্টো মুখে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। যে পথ ধরে এতটা নেমে এসেছে সেই
পথেই আবার ফিরে যেতে হবে আগের জায়গায়। তিনজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মিনিট। মনে
মনে যেন প্রস্তুত হল এক অসম যুদ্ধের জন্য।
পাঁচ
কতক্ষণ শুয়ে ছিল শৈবাল নিজেও জানে না। হঠাৎ তার জ্ঞান ফিরে এল।
চোখ মেলে তাকালো সে। মাথার পিছনে অসহ্য ব্যথা। বোধহয় পা পিছলে কোন পাথরে মাথা ঠুকে
গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। আকাশের দিকে তাকালো শৈবাল। কতগুলো পাখি সেখানে চক্রাকারে
পাক খাচ্ছে অনবরত। সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে রইল শৈবাল। তারপর উঠে বসে মাথার পিছনে
হাত রাখল। বেশ ফুলে গেছে জায়গাটা। আস্তে আস্তে মনে পড়ল, সে বিকাশকে বলেছিল, তুই এগিয়ে
যা আমি হালকা হয়ে নি। এরপর একটা পাথরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর….. তারপর…. হ্যা!
হঠাৎ পাথরের পিছনে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ তার চোখে পড়ল। সে ভয়ে লাফিয়ে সরে আসতে গেল।
আর তখনই পা টা পিছলে গেল। তারপর আর মনে নেই।
জ্বলজ্বলে চোখের কথাটা মনে পড়তেই শৈবাল ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকালো।
কোথাও কিছু নেই। সব স্বাভাবিক। বাকিরা কোথায়? আশ্চর্য! তাকে না পেয়েও কেউ খোঁজ করলো
না! খুব রাগ হল শৈবালের। অমৃতর কথা শুনে এই পথে আসাটাই সবচেয়ে বড় বোকামি হয়েছে। আর
নয়। এরপর ওদের সাথে আর কোথাও যাওয়া চলবে না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো শৈবাল।
এদিকে আলো কমে আসছে ক্রমশ। কাজেই এখানে বসে থাকার কোন মানে হয়
না। উঠে দাঁড়িয়ে জামা প্যান্টের আলগা ধুলো ঝেড়ে নিল শৈবাল। সাথে কোন আলো নেই। মোবাইলটা
আনলেও অন্তত তার টর্চটা ব্যবহার করা যেত। শ্যাওলায় সবজে হয়ে যাওয়া পাথরগুলো বাঁচিয়ে
এগিয়ে গেল সে। পায়ের নীচে মাঝে মাঝে নুড়ি পাথরে পা হড়কে যাচ্ছে। তবু থামা যাবে না।
দেবদেউলের ঠিক কোন অংশে আছে সেটা বোঝারও কোন উপায় নেই।
মিনিট পাঁচেক চলার পর শৈবালের মনে হল পিছনে যেন কেউ আসছে। মৃদু
একটা কম্পন যেন অনুভুত হচ্ছে। বিকাশ জয়ন্ত বা অমৃত মনে করে শৈবাল পিছন ফিরে তাকালো।
না! কেউ না! মনের ভুল? কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো সে। কেউ এগিয়ে এলো না। মনের ভুলই
তবে! আবার হাঁটা শুরু করল শৈবাল। কিছুক্ষণ পর আবার। কেউ নিশ্চই আছে পিছনে।
-কে? কাঁপা গলায় চিৎকার করলো শৈবাল।
কোন উত্তর নেই। পাথরে ধাক্কা খেয়ে তার চিৎকার যেন তার কাছেই ফিরে
এল। সামনে কালচে পাথরের দেওয়াল সোজা উঠে গেছে। তার উপরে গাছের জঙ্গল। মোটা মোটা
গাছের শিকড় নেমে এসে আঁকড়ে ধরেছে পাথরগুলো। একটা শিকড়ের সাথে একটা ছোট জীর্ণ সাইনবোর্ড
চোখে পড়লো শৈবালের। হিন্দিতে লেখা ‘হাড়গিলে শ্মশান’। গলার কাছটা দলা পাকিয়ে উঠলো
তার। এই সেই শ্মশান! এখানে আসবে বলেই তো কাক ভোরে বেরিয়েছিল ওরা!
তাহলে ওরা কোথায়? ফিরে গেছে কি? শৈবাল কি করবে বুঝতে পারছিল না।
পায়ের মৃদু আওয়াজ আবার পাওয়া যাচ্ছে। এগিয়ে আসছে আস্তে আস্তে। কিন্তু একটা নয়। অনেক
পায়ের আওয়াজ। মৃদু খসখস একটা শব্দ। সেই সঙ্গে নাকে এসে লাগলো একটা বোঁটকা গন্ধ। কয়েক
মুহূর্ত কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শৈবাল। একটা বড় পাথরের আড়ালে সে নিজেকে প্রাণপণ লুকিয়ে
রাখতে চেষ্টা করলো।
এবার দেখা গেল তাদের। সার দিয়ে এগিয়ে আসছে তারা। হাড়গিলে? হ্যা
হাড়গিলেই তো! একটা দুটো নয়, কয়েকশো। খুব ধীরে ধীরে শৈবালের গায়ের গন্ধ অনুসরণ করে
এগিয়ে আসছে সন্ধ্যার আবছা আলো ভেদ করে। রহমত কাল বলেছিল এখন আর হাড়গিলে দেখা যায় না।
তাহলে এত পাখি কোথা থেকে এল এখানে? অবাক চোখে চেয়ে রইল শৈবাল। ওদের সাথে দৌড়ে সে
পারবে না। আর এই পাহাড়ি রাস্তায় দৌড়াবার প্রশ্নই আসে না। কাজেই নিরবে আত্মসমর্পন করা
ছাড়া আর কোন পথ নেই। বিকাশ অমৃত জয়ন্ত! ওরাও কি এদের শিকার হয়েছে?
রহমত বলেছিল এখন আর এই শ্মাশানে কেউ আসে না। তাহলে পাখিগুলো নিশ্চই
অনেকদিনের উপোসী। ওরা কি জ্যান্ত মানুষও খায়? শৈবাল শুনেছে হাড়গিলে নাকি হাড় পর্যন্ত
খেয়ে হজম করে ফেলে। কাজেই আর কিছুক্ষণ পর শৈবালের আর কোন অস্তিত্বই থাকবেনা এই পৃথিবীতে।
মনে মনে আসন্ন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হল শৈবাল।
চোখ বুজতেই মেয়ে দিয়ার মুখটা ভেসে উঠলো সামনে। গত বছরই মিউচুয়্যাল
ডাইভোর্স হয়ে গেছে লাবণীর সাথে। মেয়ের কাস্টডি মা-ই পেয়েছে। যদিও মাসে একবার দু’দিনের
জন্য মেয়ে বাবার কাছে আসতে পারবে বলে কোর্ট রায় দিয়েছিল। আর তাকে আদর করা হবে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল শৈবালের অন্তর থেকে।
হাড়গিলেগুলো যতই এগিয়ে আসছে ততই যেন তাদের চেহারা বড় হচ্ছে। সাত
ফুট, আট ফুট, নয় ফুট। আর কয়েক মুহূর্ত ….. তারপর…..
হঠাৎ কাধে একটা আলতো হাতের স্পর্শ অনুভব করলো শৈবাল।
-অমৃত! বিস্ময়ে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হল না শৈবালের।
অমৃত আস্তে আস্তে তার জামার কলার ধরে পিছন দিকে টান দিল। শৈবাল
এক পা এক পা করে পিছনে সরতে লাগলো। কিছুটা পিছনদিকে সরে আসার পর অমৃত তার হাত ধরে
বলল,-শৈবাল কুইক! আমার পিছনে আয়।
আর কোন দিকে না তাকিয়ে শৈবাল পরিমরি করে ছুটলো অমৃতর পিছনে। ওপাশের
পায়ের আওয়াজগুলোও যেন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগলো। শিকার পালাচ্ছে বুঝতে পেরে হাড়গিলের
দল অর্ধবৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
কোনদিকে না তাকিয়ে অমৃতর শক্ত হাতের টানে ছুটতে থাকলো শৈবাল।
হোঁচট খেয়ে হাত পা ছড়ে যাচ্ছে। আবার উঠে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে ওরা। কতদূর! আর কতদূর!
জানে না শৈবাল। জয়ন্ত আর বিকাশ কোথায় তাও জানবার উপায় নেই। হয়তো ওদের আগে ওরাও প্রাণ
বাঁচাতে ছুটে চলেছে।
একসময় অমৃত থামলো। একটা বড় বটগাছের সামনে এসে সে দাঁড়িয়ে পড়লো।
শৈবালের গলা শুকিয়ে কাঠ।
কয়েক মুহূর্ত দম নিয়ে অমৃত বলল,-এই বটগাছ টার ওপাশে দেখ একটা সরু
পাথুরে সিঁড়ি উঠে গেছে। ওটাই এই শ্মশানে আসা যাওয়ার পথ। তুই ওটা দিয়ে সোজা উঠে যা।
-আর তুই? বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইলো শৈবাল।
-আমি আসছি। আগের হাড়গিলেগুলোর একটা ব্যবস্থা করি!
-ওদের আবার কি করবি? ছাড় অমৃত। গোঁয়ার্তুমি করিস না! চল আমার সাথে।
জয়ন্ত আর বিকাশ কোথায়?
-ওরা ঠিক জায়গায়ই আছে। আমি এগুলোর ব্যবস্থা করে ওদের কাছেই ফিরে
যাবো। তুই যা!
-চল চল! ছেলেমানুষী করিস না অমৃত। হাড়গিলেগুলো এসে পড়লো বলে।
কি ভয়ঙ্কর চেহারা ওদের! ওফ!
-তুই উঠতে থাক, আমি আসছি। হাড়গিলেগুলো অনেক দিনের উপসী।
-তাই তো বলছি! তোকে পেলে ওরা ছিঁড়ে খাবে। তুই চল ভাই। মিনতি করে
শৈবাল।
-তা হবার নয়। ওদের ক্ষিদে না মেটা পর্যন্ত ওরা পিছন ছাড়বে না।
তেষ্টায় শৈবালের গলার স্বর আটকে যাচ্ছে। একটু জল দরকার। তবু সে
বলল,-রহমত বলেছিল হাড়গিলে আর দেখা যায় না। তবে ওরা এলো কোথা থেকে?
-না! থাকে না! কিন্তু ভুল করে কেউ এই শ্মশানে চলে এলে ওরা আবার
জেগে ওঠে। তারপর ক্ষিদে না মেটা পর্যন্ত ঘুরতেই থাকে। তুই যা শৈবাল সময় নষ্ট করিস না।
-আর তুই? হাল ছেড়ে দিয়ে বলল শৈবাল। একটা হেস্তনেস্ত না করে অমৃত
যাবে না সে বুঝতে পারে।
-আমিই তোকে এই পথে এনেছিলাম। আমারই কর্তব্য তোকে সঠিক পথের দিশা
দেওয়া। এই সেই পথ। তুই সোজা উপরে উঠে যা। এই পথে দেবদেউলের মাঝ বরাবর একটা চাতালে
পৌছে যাবি। তারপর নীচে নামবার সিঁড়ি আছে দেখবি। যেটা দিয়ে আমরা সকালে উঠেছিলাম। পরের
পথ তো তুই চিনিস। যা আর দেরী করিস না।
অমৃতর দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে শৈবাল সরু পথটার মুখে এসে দাঁড়ালো।
অমৃত পলকহীন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। শৈবাল মাথা নাড়ালো। অমৃত মুচকি হসে ঘাড়
ঘুরিয়ে হাড়গিলেগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। শৈবাল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করেলো।
হাসপাতালের বেডে শুয়েছিল শৈবাল। জনৈক পুলিশ অফিসার একটু আগে তার
বয়ান নিয়ে গিয়েছেন।
সেদিন অনেক রাতেও তারা কেউ ফিরছে না দেখে রহমত খবর পাঠিয়েছিল সদর
থানায়। রাতেই খোঁজ খবর শুরু হয়। শৈবালকে পরের দিন সকালে দেবদেউলের উপরে একটা গাছের
গায়ে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। জয়ন্ত আর বিকাশের বডি পাওয়া যায় হাড়গিলে শ্মশানের
শেষ প্রান্তে। শরীরের অর্ধেক অংশ কারা যেন খুবলে খেয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। কারণ
ঐ অঞ্চলে গত পাঁচ বছরে কোন হিংস্র জন্তুর দেখা পাওয়া যায়নি। অমৃতর কোন সন্ধার উদ্ধারকারী
দল পায়নি। এখনও জঙ্গল আর পাহাড়ে খোঁজ চলছে।
শৈবাল যা যা ঘটেছিল সেদিন সবই জানিয়েছে। শুধু অমৃতর সাথে তার শেষ সাক্ষাতটা বাদে। সে জানে কেউ বিশ্বাস করবে না। হয়তো তাকে পাগল ভাববে। কিন্তু শৈবালই একমাত্র জানে অমৃত কোথায়। অমৃতর খোঁজ আর কোনদিনই পাওয়া যাবে না। হাড়গিলে শ্মশানের সর্বভূকদের ক্ষিদে সে মিটিয়েছে। আর ওরা যে হাড় পর্যন্ত খেয়ে হজম করে ফেলে সেটাও শৈবালের জানা।
Comments
Post a Comment