শাপ

 

ব্যপারটা প্রথম লক্ষ্য করেছিল আকাশরঞ্জন দিন পনেরো আগে। ঘটনাটা যদিও খুবই সামান্য। সেদিন অফিসের ডাকসাইটে ম্যানেজার অঘোর শাসমল খুব সাধারণ একটা কাজে ভুল হওয়ার জন্য একঘর লোকের সামনে তাকে যা নয় তাই বললেন। নিজের ভুল মেনে নেওয়ার পরেও প্রায় দশ মিনিট তাকে আরও বেশ কিছু কটু কথা শুনতে হল। মেজাজটা বিগরে গেল তখনই। নিজের ভুল সে তো মেনে নিয়েছে, তারপরেও ঐ অতগুলো বাইরের লোকের সামনে তাকে অপমান না করলেই কি চলছিল না।

দুপুরে লাঞ্চের সময় আকাশরঞ্জন খাবারটাও গলা দিয়ে নামাতে পারছিল না। দলা পাকিয়ে উঠছিল অঘোর শাসমলের কথাগুলো। পাশে বসে আনন্দ তাকে অনেক হালকা করার চেষ্টা করেও শেষে হাল ছেড়ে নিজের খাওয়ারে মন দিল। আর ঠিক তখনই কথাটা আকাশরঞ্জনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। - শালা, কন্ট্রাক্টটা ঠিক মিস করবে। আমাকে যা নয় তাই বলা! এবার উপরওয়ালার কাছে ও এর পাঁচ গুণ খিস্তি খাবে।

খবরটা এল দু-দিন পর। আনন্দই দিল। - কন্ট্রাক্ট মিস গুরু। তোর মুখ লেগে গেল মাইরি! অঘোরের ছাল ছাড়ানো হচ্ছে মিটিংরুম-এ। নিজের কানে শুনে এলাম।

স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরিয়েছিল আকাশরঞ্জন। অপমানের জ্বালাটা যেন এক লহমায় মিলিয়ে গিয়েছিল মন থেকে। গত দু-দিন তার মনে একটা বিশাল বোঝা যেন চেপে বসেছিল। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে সে বলেছিল, - প্রেডিকশন ভায়া, এলেম লাগে।

পাশে বসা আত্রেয়ী কথাটা যেন লুফে নিয়ে বলেছিল, - আপনি সব প্রেডিক্ট করতে পারেন, নাকি এটা তুক্কা লেগে গেল?

- সব পারি! কি জানতে চাও বল? মজা করেই উত্তরটা দিয়েছিল আকাশরঞ্জন। মনের বোঝা হলকা হলে মানুষ বোধহয় আকাশেও উড়তে পারে।

- আচ্ছা বলুনতো, আজ একটা বিশেষ কাজ আছে আমার, সেটা সফল হবে কি না। কি কাজ বলবো না, আপনি শুধু বলে দিন হবে, কি হবে না!

- মেজাজ তখন রামধনুর রঙে রাঙানো আকাশরঞ্জনের। কিছু না ভেবেই বলেছিল, - হু.. হু.. হু.. হয়ে যাবে। তবে দেখ আনন্দের আতিশয্যে বেশী বেসামাল হয়ে যেওনা। তবেই বিপদ।

চোখ টিপল আনন্দ। গলা তুলল, - কাজ হলে কিন্তু খাওয়াতে হবে অত্রী। সেটা মাথায় রাখিস।

- সে আর বলতে। একমুখ হাসি ছড়িয়ে বলেছিল আত্রেয়ী।

পরেরদিন আত্রেয়ী গোমরা মুখে অফিসের ডেস্কে এসে বসল। মুখ দেখেই আকাশরঞ্জন বুঝে গেল কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। সে নিজেই আগ বাড়িয়ে গিয়ে বলল, - কি হল। খারাপ খবর কিছু?

- একদম। মুখ ঝামটা দিয়ে বলল আত্রেয়ী।

- কি হল?

- আর বলবেননা দাদা। আমার শ্বাশুরীর কথা তো আপনি জানেন। বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবার চেষ্টা করছি আমরা আজ প্রায় ছ-মাস ধরে। কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না। খালি টাল-বাহানা। আবশেষে কাল একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব ভেবে রেখেছিলাম। কেন জানিনা, এককথায় রাজী হলে গেল। আপনার প্রেডিকশনের গুণেই কি না কে জানে। রাত আটটা নাগাদ তাকে আশ্রমে ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরতে দশটা হল। আমার বরকে তো চেনেন, একটু খুশির কিছু হলেই সেলিব্রেশন। আর তাতেই কাল হল। বাথরুমে পড়ে গিয়ে হাঁটুর মালাইচাকি সরে যা-তা অবস্থা। পাড়ার নার্সেংহোমে ভর্তি করতে হল মাঝরাতে। সকালে বুড়িকে আবার ফিরিয়ে আনতে হল ছেলের কাছে। আনন্দ চাপা গলায় মুখ নামিয়ে বলল, - কি ব্যপার বলতো! যা বলছিস, সত্যিই ফলে যাচ্ছে? কাল ওকে বললি, আনন্দের চোটে বেসামাল হলে বিপদ। তাই হয়ে গেল।

- কি জানি। একটু অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল আকাশরঞ্জন। নিজের কাছেও সে একটু অবাক হয়েছে এবার।

- ত্রিকালদর্শী হয়ে উঠলি না কি হঠাৎ?

- বুঝতে পারছি না!

আর কথা না বলে নিজের সীটে এসে বসল আকাশরঞ্জন। মাথার মধ্যে একটা চাপ জমে উঠছে। সে কিছু ভেবে কাল কথাটা বলেনি। মজা করার জন্যই একটু হেঁয়ালী করেছিল মাত্র। সারাদিন কথাটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফেরার পথে বিমলের সাথে দেখা। পুরনো বন্ধু, বেশ কিছুদিন বাদে দেখা হলে যা হয়। এ-কথা সে-কথায় বেশ একটু রাত হয়ে গেল। পাড়ার রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় কথাটা মাথায় এল আকাশরঞ্জনের। ওর উপর একবার প্রয়োগ করলে কেমন হয়? কি বলা যায়? একটু ভেবে সে বলল, - বিমল, কাল তুই একটা শুভ সংবাদ পাবি।

- মানে? অবাক চোখে তাকাল বিমল। - কিসের সংবাদ। কি বলছিস ভুলভাল। চা খেলেও আজকাল নেশা হচ্ছে নাকি তোর?

- না না কিছুনা! লজ্জিত মুখে মাথা নাড়ল আকাশরঞ্জন। - বাদ দে! চল ফেরা যাক।

আচম্বিতে কথাটা বলে; মনে মনে লজ্জা পেলেও, তার বলা কথা ফলে কি না সেটা জানার জন্য উৎসুক হয়ে রইল আকাশরঞ্জন। এবং দু-দিনের মাথায় জানতে পারল, তার কথা ফলে নি। যাক! তার ধারনাটা তাহলে ভুল। তার সব কথা ফলে যাচ্ছে, এটা তাহলে ঠিক নয়। মনটা আবার হালকা হয়ে গিয়েছিল তার। আসলে আনন্দই মনের মধ্যে এমন একটা খুঁতখুঁতানি ঢুকিয়ে দিয়েছিল!

মাঝে আরও দু-তিন দিন কেটে গেছে। তৃতীয় ঘটনাটা ঘটলো বাজারে। সকালবেলা মাছ কিনতে গিয়ে মাছওয়ালার সাথে দর কষাকষি নিয়ে হঠাৎই ঝামেলা বাঁধল। সাধারণত সে বাজারে গিয়ে কোন ঝুট-ঝামেলা পছন্দ করে না। কারো সাথে ঝগড়া করার মানসিকতা তার মোটেও নেই। কিন্তু সেদিন মাছওয়ালা এমন অস্বাভাবিক দর হেঁকে বসল, যে আকাশরঞ্জনের মাথাটা গেল গরম হয়ে। রেগে গিয়ে সে বলল, উল্টোপাল্টা যা খুশি বললেই হল! পকেট কাটছো, এরপর তো লোকের গলা কাটতে আরম্ভ করবে।

পরের দিন বাজারে গিয়ে আকাশরঞ্জন স্তম্ভিত হয়ে গেল। বাজারময় পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। খবর নিয়ে জানতে পারল, কোন এক মাছ বিক্রেতা, বাজারে গতরাতে এক সহকর্মীর সাথে বচসার জেরে তার গলা কেটে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তার খোঁজেই পুলিশের হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল আকাশরঞ্জনের। খবর নিয়ে জানতে পেরেছিল, তার আশঙ্কাই সঠিক। সেই মাছওয়ালাই পলাতক, যাকে কাল সে গলা কাটার কথা বলেছিল।

আনন্দের ধারনাই সঠিক। আকাশরঞ্জন যা বলছে, তাই মিলে যাচ্ছে অদ্ভুতভাবে। কিন্তু একটু ব্যতিক্রম আছে। সে ভালো কিছু বললে সেটা আদউ মিলছেনা। কিন্তু তার মুখ দিয়ে কাউকে সে অভিশাপ দিলে বা খারাপ কথা বললে সেটা আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যাচ্ছে।

ব্যপারটা বুঝে যেতেই আকাশরঞ্জন দোটানায় পরল। তার এই মুখের কথা ফলে যাওয়াটা ভাল না মন্দ সেটা সে নিজেই ঠিক করতে পারল না। যদিও নিজেকে বেশ কেউকেটা জাতীয় কিছু একটা মনে হতে লাগল তার। তার নিজের মধ্যে এই অসামান্য গুণ লুকিয়ে রয়েছে, অথচ সে নিজেই এতদিন তা জানতে পারেনি! কারো কোন কথা অপছন্দ হলেই সে এখন বাঁকা চোখে তাকায়, আর মনে মনে বলে কেন ঘাঁটাচ্ছ বাপু। এখনই বেফাঁস কোন একটা শাপ দিয়ে দেব, তারপর সারা জীবন পস্তাবে!

তার সহকর্মীরাও বোধহয় ব্যপারটা আাঁচ করতে পেরেছে! কারণ অফিসের সবাই তাকে আজকাল বেশ তোয়াজ করে চলছে বলে মনে হতে লাগল আকাশরঞ্জনের। এমনকি অঘোর শাসমলও তাকে একটু এড়িয়ে চলছে যেন ইদানিং। নিজেকেও সে সংযত করার চেষ্টা করে সবসময়। কথা বলে অনেক মেপে, চিন্তা করে। কোন কথা নেতিবচক যাতে না হয়, সে জন্য তাকে অনেক চিন্তা করে উত্তর দিতে হয়।

যদিও তার এই আশ্চর্য্য গুণ আরও বেশ কয়েকবার প্রয়োগ করেছে সে এরই মধ্যে। এবং ফলও হয়েছে। এদের মধ্যে ফলওয়ালা, সবজিওয়ালা, পাড়ার চা-য়ের দোকানের নরেনদা অনেকেই আছেন। কার‍ও যতটা সম্ভব কম ক্ষতি করে সে নিজের বিদ্যা জাহির করে দেখিয়েছে এবং যার উপর প্রয়োগ করেছে; সেও নিজের লোকসান ভুলে অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে তারিফ করতে বাধ্য হয়েছে। নরেনদা তো চোখ ছানাবড়া করে বলেছিলেন, -তোমার এই গুণ এখনকার নেতাদের উপর প্রয়োগ করে দেখ না! যদি কাজ হয়, দেশের অনেক মঙ্গল হয়। সব ব্যাটাকে জাহান্নামে যদি পাঠাতে পার, তো বুঝি তোমার এলেম!

সে চেষ্টা অবশ্য আকাশরঞ্জন করে দেখেনি, তবে পাড়ার অকেজো কাউন্সিলর ধ্রুপদ বাগচী একটু হলেও টের পেয়েছে কাজে ফাঁকি দেওয়ার মজা।

সহজ কথা হল আকাশরঞ্জন নিজের শক্তির গুণে বেশ একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হয়ে উঠেছে ইদানিং। সবচেয়ে তার ভাল লাগে এই ভেবে যে, যে বউকে সারা জীবন ভয়ে ভয়ে তোয়াজ করে চলে এসেছে, সমঝে চলেছে বছরভর, সেই উমাও তাকে এখন যখন তখন ‘প্রেমের বাণী’ না শুনিয়ে বেশ তোষামোদ করে কথা বলছে। আগে যা ছিল হুকুম, এখন তা অনুনয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজটা যদিও পাল্টায়নি, কিন্তু উমার কথার ধরনটা যে সে পাল্টাতে পেরেছে সেটা ভেবেই আকাশরঞ্জন বেশ আত্মতৃপ্তি বোধ করে।

 

সেদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ গোমরা। ভোরের দিকে বেশ একটু বৃষ্টিও হয়ে গেছে। অফিস যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না আকাশরঞ্জনের। কিন্তু একটা জরুরী মিটিং আছে, না গেলেই নয়। বিছানায় বসেই দু-কাপ চা হয়ে গেছে এর মধ্যেই। তৃতীয় কাপের ফরমায়েশ করবে কি না ভাবছে, এমন সময় উমা ঘরে ঢুকে বলল, -কি হবে? আজ অফিস যাওয়ার ইচ্ছা আছে না অন্য মতলব?

আলগোছে আড়মোড়া ভেঙে আকাশরঞ্জন বলল, -যেতে হবেই। জরুরী মিটিং। আমাকে না বসিয়ে আজকাল আর মিটিং হয়না বুঝলে। আমার মতামতের একটা দাম আছে! হেড অফিস শাসমলের থেকে আমার কথার বেশী গুরুত্ব দেয় এখন। কাজেই .......

-সেতো হবেই। যা নজর হয়েছে তোমার এখন। ঠিক নজর না! জিভ!

-ওভাবে বল না। আমার কথা যদি ফলে যায়, সে কি আমার দোষ!

উমা উঠে গেলে আকাশরঞ্জন একটা সিগারেট ধরালো আলগোছে। আজকের মিটিংটা নিয়ে মনে মনে একটু ঝালিয়ে নিয়ে উঠবে সে। একটা নাগাদ মিটিং, কাজেই অত তাড়া নেই। তার অফিসে ঢোকার সময় নিয়ে আজকাল কেউ আর কিছু বলে না। মুক্ত বিহঙ্গ যেন! যখন খুশি যাও, যখন খুশি আস। নৃপতিদা এ্যাটেন্ডেন্সটা দেখে, আগে দশটা কুড়ি হয়ে গেলেই আড় চোখে একবার তার মুখ আর একবার দেওয়ালে ঝোলান ঢাউস ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে জিভে চুক চুক শব্দ করে বলতেন, - আজ যে আবার লেট হল আকাশ। টাইমটা একটু....... আর এখন তাকে দেখলেই এক মুখ হেসে বলেন, - এই এলে! নাও নাও আগে সইটা কর চট করে, চা টা পরে খেও। আমিই না হয় অর্ডার করে দিচ্ছি।

দশটার দিকে আবার ঝমঝম করে বৃষ্টি এল। আকারশরঞ্জন সবে রাস্তায় নেমেছে তখন। উমাও ছেলেকে নিয়ে স্কুলের জন্য বেড়িয়েছে। আজ যেতে মানা করেছিল সে, উমা শুনল না। ক্লাস টেস্ট আছে, যেতেই হবে। এখনকার স্কুলগুলোর এই এক হয়েছে! রোজ রোজ ক্লাসটেস্ট। এদের নিয়ে একটু ভাবতে হচ্ছে! মাথার মধ্যে চিন্তাটা নিয়েই সে অটোর লাইনে দাড়াল। উমা ছেলেকে নিয়ে টালিগঞ্জের অটোর দিকে চলে গেল।

একটু বৃষ্টি হলেই সমস্যা। অটোর লাইন সাপের মতন এঁকে বেঁকে চলে গেছে অনেকটা। বিরক্ত আকাশরঞ্জন আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন। নেগেটিভ কিছু বলবে নাকি! প্রকৃতির ক্ষেত্রেও খাঁটবে কি তার মুখের কথা! অটোর লাইনে সে আর দাড়ল না। অন্য কিছু দেখতে হচ্ছে। এ লাইনে দাঁড়ালে একটার মধ্যে অফিস পৌছানো অসম্ভব। রাস্তার উল্টোদিকে এসে সিগারেট ধরালো সে। যদি শেয়ার ট্যাক্সি পাওয়া যায়। আকাশের যা অবস্থা হয়েছে, সহজে আজ আর নিস্তার আছে বলে মনে হয় না। আজ মিটিংটা ক্যানসেল হলেই ভালো হত।

অন্যমনস্ক হয়ে নানা কথা চিন্তা করতে করতে আকাশরঞ্জন সামনের দিকে এগিয়ে গেল। আকাশ যেন আরো কলো হয়ে আসছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মেঘের ডাক আর একঘেঁয়ে বৃষ্টিধারার শব্দে ম্যারম্যারে সকালটাকে মনে মনে গাল দিতে দিতে সে ইতি-উতি চাইতে লাগল। আয় বাবা একটা শেয়ার ট্যাক্সি!

হঠাৎ একটা অটো প্রায় গায়ের উপর উঠে এল আকাশঞ্জনের। আর একটু হলেই ডান পাটা চাকার তলায় ঢুকে যাচ্ছিল। দোষটা যদিও তারই। নিজের অন্যমনস্কতা আর অলস চিন্তা। দূর্ঘটনা তো এভাবেই ঘটে। চমকে সম্বিত ফিরে পেল সে। - এই এই! চিৎকার শুরু করার আগেই বুঝতে পেরে অটোওয়ালাটা গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে এগিয়ে গেল। রাগে মাথার রগ ফুলে উঠল আকাশঞ্জনের। যানে কাকে চাপা দিতে যাচ্ছিল? মনে মনে একটু ভেবে নিয়ে সে বলল, আজ তোর শেষ শালা।

অফিস পৌছতে প্রায় পৌনে একটা হয়ে গেল। কিছুই না পেয়ে শেষটায় ওলা বুক করে আসতে হল। জামা-প্যান্ট ভিজে জবজব করছে। বৃষ্টির সাথে একচোট ঝড় ও হয়ে গেছে এই মধ্যে। নৃপতিদা খাতাটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, -এ্যাঁ হ্যাঁ, ভিজে গেছ যে একেবারে! না এলেই পারতে। মিটিং ক্যানসেল।

পিছন থেকে আনন্দ বলল, - তোকে কতবার ফোনে ট্রাই করলাম।

- নেটওয়ার্কের যা হাল আজকাল। জামার উপর হাত বোলাতে বোলাতে বলল আকাশরঞ্জন। - একটু চা বল মাইরি, ভিজে একেবারে আমসি হয়ে গেছি। চা খেয়েই কাটব। আনন্দ তুই ও পালা। যা অবস্থা, বিকাল পর্যন্ত্য চললে বাড়ি ফেরার আর কিছু পাবি বলে মনে হয় না।

- আমার কি আর তোমার মতন প্রেডিকশনের ক্ষমতা আছে ভায়া! এখন কাটলে, কাল আমায় কাটা হবে। তুমি মুক্ত বিহঙ্গ। পাখা মেললেই হল।

তখনই কথাটা মনে পড়ল আকাশরঞ্জনের। আজ আবার একবার তার ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে সে। ত্যাদোর সেই অটো। হু। কাকে চাকার তলায় দলতে এসিছিলে বাবা! টেরটি পাবে।

গরম চায়ে চুমুক দিয়ে চেয়ারে এলিয়ে দিল শরীরটা। উমা আজ স্কুলে না গেলে; বাড়ি গিয়ে সোজা খিচুরির অর্ডার দেওয়া যেত। তুতানও খুব ভালোবাসে। গরম খিচুরি আর ডিম ভাজা। আঃ! সন্ধেটা জমে যেত।

- অঘোর শাসমল বোধহয় এবার কাটছে। বলল আনন্দ।

- কাটছে মানে?

- শুনলাম বর্ধমানে ট্রান্সফার। এখনও লেটার পায়নি, তবে পাকা খবর। তুই একটু চেষ্টা করলে চেয়ারটা তোর হতে পারে। তোর যা ক্ষমতা হয়েছে ইদানিং।

মনটা আর একবার নেচে উঠল। এমন একটা কানাঘুসো সেও শুনেছে। শাসমল বিদায় হলে তার পদোন্নতির একটা সম্ভাবনার কথা সেদিন বিরেন সেন বলছিলেন বটে।

- পাকা খবর! বলছিস?

- একদম! এ ব্যাপারে আনন্দর প্রেডিকশন মিস হবে না ভায়া।

ঘরে একটা হাসির হালকা তরঙ্গ উঠল। আর তারই মধ্যে মোবাইলটা বেজে উঠল আকাশরঞ্জনের। হাসতে হাসতে টেবিলে রাখা ফোনটা আলগোছে তুলে কালে ঠেকাল সে।

- হ্যালো! ওপাশ থেকে গম্ভির একটা কন্ঠ বলে উঠল।

- কে! বিরেন দা? মাথার মধ্যে তখন প্রমোশন ঘুরছে। তাই এই নামটাই মনে এল তার।

- না। সুবিমল। সুবিমল মান্না। টালিগঞ্জ থানা।

নড়ে চড়ে বসল আকাশরঞ্জন। থানা?

- আপনাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? আর আপনারই বা দোষ কি। যা অবস্থা চারদিকে।

- বলুন শুনছি। আমতা আমতা করে বলল আকাশরঞ্জন।

- একবার বাঙ্গুর হসপিটালে আসতে হবে।

- কেন বলুনতো?

- একটা এ্যাক্সিডেন্ট। মানে উমাদেবী আপনার স্ত্রী, তাইতো?

- হ্যা।

- একটা অটো, মানে আপনার স্ত্রী আর ছেলে, মানে বোধহয় স্কুলে যাচ্ছিলেন, তাইতো?

- হ্যা। গলাটা নিজের অজান্তেই ভারি হয়ে এল আকাশরঞ্জনের। সকালের সেই অটোর কথা মাথায় ঘুরে এল তার।

- হু! একবার আসুন। এই নাম্বারটা সেভ করুন। হসপিটালের সামনে এসে আমায় কল করবেন। রাখছি। একটু তাড়াতাড়ি আসুন। জানি রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ। তাও চেষ্টা করুন। প্লিইইজ।

Comments

Popular posts from this blog

ছুটি

প্রতিশোধ

পরশ পাথর