শেকল_ছেঁড়ার_ডাক

 

আমার একটি স্ত্রী আছেন, যেমন সবার থাকে। আমার একটি তিলে খচ্চর পুত্র আছেন, যেমন সবার থাকে। যেটা নেই সেটা হল ছেলের প্রতি তার মায়ের শাসন। তিনি বর্তমানে তার দিনের বেশীর ভাগ সময়টাই ব্যয় করেন আমাকে শোষণ করে। বাকি সময়টা ব্লাডি মেরি খেলে। না না! ভুল করছেন! তিনি আয়নার সামনে বসে রূপচর্চা করেন কেবল। আমি দিনে দুপুরেও পিছন থেকে হঠাৎ আয়নায় চোখ পড়লে ঐটে ভেবে ভিরমি খাই। আমি চিরকালই একটু বেশী মাত্রায় ভীতু গোছের লোক। গেছো টাইপের মোটেও নই। এ মাৎ করো ও মাৎ করো এই বলেই বাড়ি মাত করে রাখেন তিনি সারাদিন। আর ছেলেটাও হয়েছে তেমনি। কখন কোন প্রদীপে কখন তেল দিলে সেটা ঠিক ঠিক জ্বলবে এই বয়েসেই রপ্ত করে নিয়েছে।

এখন দুপুর বেলা। তিনি ছোট্ট একটি ভাত-ঘুম দিচ্ছেন পাশের ঘরে। বসার ঘরে বসেও তার টিকোলো নাকের ফর্-ফর্ ধ্বনি আমি শুনতে পাচ্ছি। এটাকে নাক ডাকা ভেবে ভুল করবেন না! আসলে যেটা হচ্ছে, সেটা হল তিনি নাকটিকে রিচার্জ করে রাখছেন এই বেলা। পরে সর্ব বিষয়ে যাতে সেটা সুচারুরূপে গলাতে পারেন।

বসার ঘরটিতে একটি ছোট চৌকি আছে আমার। সেখানে চৌকিদারি করছি বসে। অর্থাৎ আমার পুত্র সন্তানটি অনলাইনে স্কুলের যে পরীক্ষাটি দিচ্ছেন, সেটি সঠিক উপায় অবলম্বন করে দিচ্ছেন কি না সেটা অনুধাবন করছি। 

লকডাউনের বাজার। কাজেই বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। মাঝে একদিন চেষ্টা করেছিলাম। বড় রাস্তায় উঠবার আগেই দেখি পাড়ার নিকুঞ্জ কাকু লুঙ্গিটা হাতে নিয়ে তার শত তাপ্পি মারা আন্ডারওয়্যারটি পড়েই পরি-মরি করে গলিতে ঢুকে এলেন। ছুটতে ছুটতে পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলেলন,-বাঁচতে চাইলে পালাও, পাআলাআওও!

-কি কাকু! কোভিড?

-না না কোভিড নয় ডেভিড। তিনি দূরে মিলিয়ে গেলেন মুহূর্তে।

ডেভিড আমাদের পাড়ার একটি ব্যাচেলর ষন্ড। ষন্ডা মার্কা চেহারা বলে এই নাম। এমনিতে শান্ত শিষ্ট। কিন্তু ক্ষেপে গেলে…! তাকে কি কলকাতা পুলিশ ভলেন্টিয়ার করে মাঠে ছেড় দিল না কি?

পরে অবশ্য আসল কথাটা জেনেছিলাম। ফাঁকা রাস্তায় ডেভিডকে একা পেয়ে নিকুঞ্জ পুরকাইত কিছু একটা অসভ্যতা করে ফেলেছিলেন (ওনার সম্বন্ধে আগেও কিছু কানাঘুষো শুনেছিলাম বটে, সেটা দেখছি সত্যি! আমাকেও সাবধানে থাকতে হবে এবার থেকে কারণ যিনি ষাড়কে ছেড়ে কথা বলেন না তার কাছে আমিতো নস্যি!)। আর তাতেই সেই অবোধ এঁড়ে ক্ষেপে গিয়ে তেড়ে গিয়েছিল। তাতেই পুরকাইত পুরো কাইত, মানে কাত আরকি!

এবার কাজের কথায় আসি। যার জন্য আমার আজকের এই লেখনী ধরে লেখা। আজ, এই ধরুন প্রায় বারোটা নাগদ আমার মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠলো। গিন্নী তখন বাথরুমে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ফিল্মি গান নিয়ে কসরত করছেন। আমি সবে রান্নার বাসনগুলো মেজে রৌদ্রে দিয়ে হালকা হয়ে বসেছি।

কানে নিয়ে হ্যালো বলতে ওপাশ থেকে একটি মহিলা কন্ঠ বলল,-চিনতে পারেন? কে বলুন তো?

সত্যি বলছি, বহুদিন এমন সুরেলা কন্ঠ (আমার বউয়ের গলাটা বাদ দিয়ে) শুনিনি। কদিন আগে ছাদে সান্ধ্য ভ্রমণের সময় পাশের বাড়ির সুলেখা বৌদির দিকে লুকিয়ে কয়েকবার আড়চোখে তাকিয়েছিলুম বলে সাতদিন কড়াই স্যাতলানোর (পাতি ভাষায় রান্না করার। একটু কাব্যিক করে বোললে শুনতে আর শোনাতে ভালো লাগে) শাস্তি ভোগ করেছি।

অচেনা গলাটা আমাকে রীতিমতো চিন্তায় ফললো। আমি আমতা আমতা করে বললুম,-আচ্ছা আমি ফোনে গলা চিনবো কি করে বলুন তো? কে সেটা বলে ফেলুন না, তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়! মনে মনে বললাম, গিন্নীর সাথে লাঠালাঠিরও আর সম্ভাবনা থাকে না তাহলে।

-আমি স্ট্রবেরি।

-কি! স্ট্রবেরি? লাইনটা কেটে কেটে যাচ্ছে। আমার কানে এটাই ধরা পড়েছে।

-ধুর বাবা! কাবেরী কাবেরী।

-ও কাবেরী। তাই বলুন। যদিও অচেনা মেয়েদের স্ট্রবেরি ভাবতে আমার মন্দ লাগে না।

এবার চিন্তা হলো কে এই কাবেরী। মিস না মিসেস্। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। আমার যা মিস হওয়ার তা হয়ে গেছে।

-কে কাবেরী? প্রশ্নবান ছাড়লুম।

-আপনার ঋতব্রত আর আমার উলালা যে একই স্কুলে পড়ে।

-উলালা! আমার পুত্র যেখানেই পড়ুক, আমি আকাশ থেকে পড়লাম। -উলালা কারো নাম হয়?

-এ্যাই! না না! ওর পুরো নাম উর্মিলা লাহা। আমরা শর্ট করে উলালা বলি।

-তাই বলুন! আমি একটু আস্বস্ত হই। হাঁ করে হাঁপ ছাড়ি একটু।

-বুঝলাম। তা এবার দরকারটা কি বলুন?

-আসলে বড় রাস্তার বেহাল অবস্থা নিয়ে একটা গন্ডগোল হচ্ছে শুনেছেন তে!

-হ্যাঁ শুনেছি বটে। কিছু একটা হচ্ছে। কতটা কথার কচকচানি আর কতটা কাজের কলরব তা বলতে পারি না। তবে প্রতিবাদ হওয়া উচিত অবশ্যই।

-হুম! আমরা চাইছি আমাদের হাত যেন আরো মজমুত হয়। বুঝলেন! লোক বল দরকার।

-বুঝলাম! আপনারা আপনাদের মরচে পড়া সাহসটাকে পুনরুজ্জীবিত করে মোর্চা করতে চাইছেন।

-উফ! ফাটাফাটি। আপনি দারুন বলেন।

মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। ফটাফট উত্তর দিলাম,-ওই আর কি! আগে একটু আধটু লিখতাম.. ইয়ে.. মানে তার রেশ কিছুটা রয়েছে এখনও, রাশ টানতে পারিনি। হেঁ হেঁ!

-দারুন দারুন। আপনার কাছে আমার একটা আরজি রয়েছে।

-হ্যাঁ বলুন না! আমি উৎসাহিত হই স্ট্রবেরি এই… কি বলে কাবেরীর কথায়।

-আপনাকে কিন্তু আসতেই হবে। আগামী সোমবার।

-কোথায়? আমি আপ্লুত।

-বড় রাস্তার মোড়ে। আমরা সবাই আসছি।

-আমি… এবার ঢোক গিললাম। ঢুক করে গিলে নিলাম! এই অবস্থায় মরে গেলেও মোড়ে যাওয়ার ইচ্ছা আমার বিন্দু মাত্র নেই।

-প্লিইইজ। আমি বলছি।

-ইয়ে মানে মিসেস গেলে চলবে কি? আমি একটা চাল দেওয়ার চেষ্টা করি।

-নাহ! আমাদের পুরুষ মানুষ চাই। আর আপনি যা কথা বলেন, আপনাকে আমরা লিডার করবো ভাবছি।

হুম! মনে মনে ভাবি। লিডার করে উপরে তুলে ল্যাডার কেড়ে নেবে না তো!

-চুপ কেন? আসছেন তো? আমার জন্য প্লিজ।

খুব সংকটে পড়েছি বুঝলেন! কি যে করবো বুঝে উঠতে পারছি না। নিজের সাথে জুঝে উঠতে পারছিনা মোটে। একটা বুদ্ধি দেবেন প্লিজ কেউ ম্যাসেজ করে!

Comments

Popular posts from this blog

ছুটি

প্রতিশোধ

পরশ পাথর