একটি সাহিত্যমূলক রচনা



একটা সময় ভাবতাম, গল্প কবিতা লিখে বেশ একজন কেউকেটা হয়ে উঠব। ছেলেবেলায় দু-তিনটে লিটল ম্যাগাজিনে কিছু লেখা বেরিয়েছিল। প্রতি বছর স্কুল পত্রিকায় আমার লেখা একটা না একটা থাকতই। তাতে অহংকারের মাত্রাটা আরও অনেক বড় হয়ে উঠেছিল। মাস্টারমশাইরাও প্রশংসা করতেন লেখার, বিশেষ করে বাংলার সুভাষ স্যার। বলতেন, লেখাটা ছাড়িসনে বাবা! হাত পেকে গেলে মন্দ হবি না। পাকা কাঁঠালের মতন যদি একবার পাঠক সমাজে গন্ধ ছড়িয়ে দিতে পারিস, ব্যাস, মার দিয়া কেল্লা! ক্লাসের বন্ধুরা বেশ সমীহ দৃষ্টিতে, মুগ্ধ হয়ে তাকাতো তখন। পাশে বসা সুবল ও দেখতাম আমার পাশে অনেকটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে গুটিসুটি মেরে সরে বসেছে। সমবয়সী বন্ধুদের একটু নেক নজরে দেখতাম। হুঃ! তোরা কি আমার মতন লিখতে পারিস! লেখাটা একটা শিল্প, আর শিল্পী সবাই হতে পারে না। নিজেকে নিজেই কথাশিল্পী তকমা দিয়ে দিয়েছিলাম বন্ধুদের উপর ভরসা না করে। কারণ, কথাশিল্পী কথাটার মানেই হয়ত তারা জানে না। তাদের মতন অবোধ বালকদের কাছ থেকে নিজের প্রতিভটিকে সযত্নে নিরাপদ দূরত্বে রাখার দায়িত্বটা নিজেকেই নিতে হয়েছিল আমার। পাছে সাহিত্যের সুললিত শব্দ বন্ধুদের নিরীহ কানে জোরে ধাক্কা দিয়ে তাদের বিচলিত করে তোলে, তাদের অজ্ঞানতাকে আমার সামনে আরও বেশী নগ্ন করে তোলে, সেই কারণে গম্ভীর মুখে বসে থাকাটাই আমার কাছে যথাযথ মনে হত। যদিও সেই কারণে অনেকে আমাকে দাম্ভিক মনে করতে শুরু করেছিল, কিন্তু তাতে কিছু করার নেই। সকলের ভালর জন্যই যে আমার এই আচরণ, তা তাদের বোঝাতে যাওয়াও তো এক ঝকমারি! সাহিত্য-মিশ্রিত যে সব কথা আমাকে বলতে হবে, তাও তাদের মাথার কত হাত উপর দিয়ে যাবে সে সম্বন্ধে সত্যি বলতে কি আমার নিজেরও ধারনা ছিল না। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে, কলেজেও এই একই ধারা বজায় রাখতে আমি নিজগুণেই সামর্থ্য হয়েছি। সেখানে কচি-কাচা কিছু মেয়েদের মুদ্ধকর চাহনি যে আমাকে মাঝে মাঝে নিজের পথ ও পণ থেকে বিরত হওয়ার আহ্বান জানায়নি তা নয়, তবু প্রবল মানসীক যুদ্ধে আমি জয়লাভ করেছি। বিখ্যাত সব সাহিত্যিক ও তাদের ঝুড়ি ঝুড়ি উক্তি আমাকে প্রতিনিয়ত নিজের আশ্রিত পথে অবিচল থাকতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
মাঝে সময় গড়িয়েছে অনেক। ছেলাবেলার সেইসব অজ্ঞান, মুগ্ধদৃষ্টি প্রদানকারী বন্ধুরা সব ছড়িয়ে পড়েছে কে কোথায়, তার আর খবর রাখা আমার হয়নি। নিজের সাহিত্য, কথাশিল্প নিয়ে আমি এতই ব্যস্ত ছিলাম যে সাধারণ মানের কিছু ছেলে, তাদের গতিপথ কোনদিকে ঘুরে যাচ্ছে সে খবর নেওয়ার সময় বা তাগিদ কোনটাই আমার ছিল না। আপাত-গম্ভীর স্বভাবটা এখনও আমার রয়ে গেছে। নিজেকে রাশভারী ভাবতেই আমার ভাল লাগে এখনও। অন্তত সেই রকমটাই জাহির করার একটা প্রচেষ্টা আমার মধ্যে রয়ে গেছে। কিন্তু যেটা হয়নি সেটা খুবই হতাশাজনক এবং অনভিপ্রেত। নাঃ! সাহিত্যটাই হল না। সময়োচিত লেখাই আমি লিখলুম, কিন্তু পাঠকের পাতে তা তেমন নতুন রসের স্বাদ দিতে পারলে না। টক, ঝাল, নোনতা, মিষ্টি কোনটাতেই তেমন লাভ হল না। প্রকাশকের নাক উঁচু ভাবটাকে কিছুতেই নিজের কল্পনা রসে চিঞ্চিত লেখার সাথে মিলিয়ে দিতে পারলাম না। এক কথায় আমার কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায় প্রস্তুত করা উচ্চ শৈল্পিক কাজ, পাঠক ও প্রকাশক সবার মাথার বেশ ক-হাত উপর দিয়ে চলে গেল। আমার সাহিত্য, নব অঙ্কুরিত চারা গাছ থেকে আর মহীরূহে পরিনত হওয়ার অবকাশ পেলে না। আমার এক নব্য সাহিত্যমুগ্ধ বন্ধুর (কিংবা ভক্তের) বারংবার অনুরোধ ফেলতে না পারায়, সোশ্যাল-মিডিয়া নামক স্থানেও বিস্তর চেষ্টা চালালুম, কিন্তু হা-হতোস্মি। সেখান থেকে যা সব কমেন্টস্ পেলাম, সত্যি বলতে কি সেগুলিই বরঞ্চ কারো পাতে দেওয়ার যোগ্য নয় (নিপাট গালাগাল কারও পাতে দেওয়া যায় কি?) আমার এই লেখায় সেগুলি ব্যবহারের উপযোগী নয় মোটেই। এতে আমার কথাশিল্প সম্বন্ধে আপনাদেরও সন্দেহ জাগতে পারে। কাজেই সেগুলি আর উল্লেখ করছি না।
তবে একেবারে যে বিফল হয়েছি তাও বলতে পারি না। বলা একেবারেই উচিত নয়। দিতে যখন পারলাম না তখন নিতে-ই ঠিক করলাম। অর্থাৎ কিনা জীবনটাকে উৎসগ্গ করলাম বলা চলে। এ আমার এক আত্মবলিদান (বলিদান ভিন্ন কোন মহৎ উদ্দেশ্য সম্ভবও নয় বলে শুনেছি)। কথাশিল্প তৈরীর খোদ কারখানা খুলে বসেছি এখন। হ্যাঁ! ঠিকই শুনছেন, একটি চা-য়ের দোকান খুলেছি বর্তমানে। নিজের জীবন-দর্শন থেকে বুঝেছি, কথাশিল্পের থেকে চা-শিল্প কোন অংশে কম নয়। লেখকের যেমন চা না হলে চলে না (কবিগুরু কি সাধে বলেছেন, ‘‘আমার পরাণ যাহা ‘চা’-য়, তুমি তাই হে’’! তুমি ছাড়া আর এ জীবনে.... ইত্যাদি ইত্যাদি) চায়ের দোকানে এলে তেমনি সকলে লেখক হয়ে ওঠে (নিদেন পক্ষে কথক তো বটেই)। আর আমি বর্তমানে সেই সকল ‘কথা-শিল্প’ সংগ্রহের কাজে মনোনিবেশ করেছি। খুব-শিঘ্রই ফিরে আসব বৃহৎ এক সম্ভার নিয়ে, আর বেশী দেরী নেই।
আর একটা কথা, সেই সুবলকে মনে আছে আপনাদের? আমার সম্মানে যে নিজেকে স্কুল বেঞ্চের এক কোনায় সরিয়ে নিত। সে নাকি এখন বাংলা সিনেমার একজন সফল চিত্রনাট্যকার!
হুঃ! যত্তসব......!

Comments

Popular posts from this blog

ছুটি

প্রতিশোধ

পরশ পাথর