আত্মজীবনীর ছেঁড়া পাতা



তিন কামরার ছোট ফ্ল্যাট। একটা বসবার, দুটো শোওয়ার। একটা আমার মায়ের, একটা আমার। পশ্চিমে একফালি সরু ব্যালকনি। আমার নিঃসঙ্গ মায়ের একমাত্র সম্বল।
ওখান দিয়ে সূর্য অস্ত যায়। মাথার উপর দিয়ে পাখির দল উড়ে যায় ক্লান্ত সূর্যটার দিকে। এই চার তলায় বসে নাকি খুব ভালো দেখা যায়। আমি কোনদিন দেখিনি। রাত্রে মায়ের মুখে শুনি। শুনি বিকেলের সন্ধ্যা হওয়ার গল্প। সন্ধ্যার রাত্রি হওয়ার গল্প। রাত্রির আরও গভীর হওয়ার গল্প।
আমার মা খুব ভালো গল্প বলতে পারেন। ছেলেবেলায় গল্প শুনে আমরা ঘুমোতাম। আমি আর আমার দিদি। মা আমাদের অপু-দুর্গার গল্প বলতেন। দিদি মায়ের এক কোলে, আমি আর একটায়। দু চোখের পাতা এক হয়ে আসত মায়ের সুরেলা গলায়। স্বপ্নের রঙীন হাতছানির মধ্যে শুনতাম দিদি বলছে, তারপর?
আমাদের বাবা কলকাতা শহরের বুকে একটু একটু করে নিজের ছোট ব্যবসা গড়ে তুলেছিলেন। কাজের মানুষ। সারাদিন নিজের কাজেই ব্যস্ত। স্ত্রী-ছেলেমেয়ের প্রতি সেভাবে নজর দিতে পারতেন না। প্রায় প্রতিদিনই বাড়ী ফিরতেন অনেক রাত্রে। আমরা তখন মায়ের কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি। পরের দিন ঘুম চোখে যখন আমি স্কুলে যেতাম, আমার বাবা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
বাবার সঙ্গে এই ছিল সম্পর্ক। মাকেই আমরা ভাই-বোন জড়িয়ে ছিলাম। আমাদের মা-ই ছিলেন সব। সমস্ত আদর আবদার, চাওয়া-পাওয়ার কেন্দ্র বিন্দুতে মা। বাবা কোন অভাব রাখেননি আমাদের। তবু মানুষটা যেন অনেক দূরের ছিলেন। অপরিচিত। অন্যরকম।
আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। যথারীতি মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছি। কখন জানিনা হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘরে হালকা নীল আলো, আমার স্বপ্নের মতন। পাশের ঘর থেকে চাপা গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে। দিদি কখন যেন উঠে বসেছে। ঘুম চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
‘ভয় করছে ছোটকা?’ দিদি নিজেই ভয় ভয় গলায় জানতে চাইল।
দরজার ফাঁক দিয়ে টিউবের সাদা আলো গড়িয়ে আমাদের ঘরে এসে পড়েছে। আমরা ভাই বোন দরজা ঠেলে অবাক চোখে তাকালাম।
মা বিছানার এক কোণে বসে আছেন নিশ্চুপ। মুখে আঁচল দিয়ে কান্না চাপার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন আমাদের মা। বুক ঠেলে বেরিয়ে আসছে চাপা গোঙানি। মায়ের শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। বাবার পা দুটো দেখলাম ঘরের মাঝখানে। মেঝে থেকে অনেক উঁচুতে।
আমাদের বাবা কি স্বার্থপর ছিলেন? তা না হলে এভাবে চলে গেলেন কেন? আমাদের সবাইকে এভাবে ফেলে! মাকে ফেলে! বাবা একটা চিঠি লিখে গিয়েছিলেন। মায়ের কাছে রাখা ছিল। আমি একদিন লুকিয়ে দেখেছিলাম।
মায়ের কাছে কাতর ভাবে ক্ষমা চেয়েছিলেন বাবা। ‘শোভনা, আমায় ক্ষমা কোর। আমায় তোমরা ভুল বুঝো না। এছাড়া কোন পথ ছিল না। আজ কিছুই নেই যা নিয়ে তোমাদের সামনে দাঁড়াতে পারি। আজ আমি দেউলিয়া হয়েছি। আমায় তোমরা ক্ষমা কোর।’
আমার বাবা কাজের মানুষ ছিলেন। কাজ ছাড়া বাঁচতেন কি করে। তাই চলে গেলেন।
মাকে অনেকদিন রাত্রে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে দেখেছি। নিজের মনে বিড়বিড় করতেন, আমি তো ছিলাম। আমরা আবার সব গড়ে তুলতাম। তুমি এত সহজে হেরে গেলে?
মা গুমরে গুমরে কাঁদতেন। আমরা যেন বুঝতে না পারি। আমরা বুঝতাম। দিদি অসহায়ের মতন আমার দিকে তাকাত। আমাদের নড়বড়ে খাট কেঁপে কেঁপে উঠত।
আমার বয়স যেন হঠাৎ করে কয়েক বছর বেড়ে গেল। আমিই তো এখন পরিবারের একমাত্র পুরুষ। আমাকেই এবার হাল ধরতে হবে। বাবার মতন তো আমি নই। আমি লড়ে যাব মায়ের মতন। আমার আচরনে শত কষ্টেও মা হেসে ফেলতেন। মাথায় হাত রেখে চুলগুলো নেড়ে দিতেন। সারাদিন স্কুলে পড়িয়ে এসে মাঝরাত পর্যন্ত সেলাই কলে মুখ গুঁজে থাকতেন মা।
আমাদের আর গল্প শোনা হত না। অনেক রাত অবধি মেশিনের একঘেয়েমি ঘর্ ঘর্ শব্দের মাঝখানে ছটফট করে একসময় ঘুমিয়ে পড়তাম। দিদি মাকে সাহায্য করত।
আমি মাঝে মাঝে বাবাকে স্বপ্নে দেখতাম। সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে আঙ্গুল তুলে বলতেন, ওঁর বড্ড কষ্ট হচ্ছে ছোটকা। একটু তাড়াতাড়ি বড় হয়ে নে।
আমি বলতাম, আপনি অমন করে চলে গেলেন কেন?
বাবা হাসতেন, আমার সময় যে শেষ হয়েছে। সময় পেরিয়ে গেলে কেউ আর থাকে না।
আমিও চলে যাব?
যাবে। তবে তোমার যে অনেক কাজ বাকী। আগে কাজ শেষ কর!
মেসিনের একঘেয়ে আওয়াজে আমার চোখে জল আসত। বাবা আমার মাথার কাছে এসে বসতেন। সেই সময় বাবাকে পরম বন্ধু বলে মনে হত। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, আমি ঘুমিয়ে পড়তাম।
বাজারে বাবার অনেক দেনা হয়েছিল। বাড়ি বিক্রি করে আমরা চলে এলাম ভাড়া বাড়িতে। মা বলতেন, ছোটকা বড় হয়ে আবার সব করবে।
দিদির পরিবর্তন এল। মায়ের চিন্তা বেড়ে গেল। দিদি বড় হচ্ছে। মেশিনের ঘর্ ঘর্ মাঝরাত ছাড়িয়ে ভোররাত পর্যন্ত গড়িয়ে গেল।
বাবা বললেন, তোর মা যে এবার মরে যাবে।
দিদির বিয়ে দিতে হবে যে!
বাবা হাসলেন, তুমি এতসব জানলে কি করে?
আমিও তো বড় হচ্ছি না কি!
চিন্তিত বাবা বললেন, হ্যাঁ মেয়েটার বিয়ে দিতে হবে।
দিদির বিয়ে দিতে হল না।
এক বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় বাবার মতন সেও চলে গেল। আমাদের ভাড়া বাড়ির লাল মেঝে থেকে তিন ফুট উপরে ওর পা দুটো একটু একটু দুলছে। মা মাটিতে পাথর। ঘরের একমাত্র ষাট পাওয়ারের বাল্বটা বিস্ফারিত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে। আমি তখন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র।
বাবার মতন একই ভাবে দিদি চলে গেল। মাকে লিখে গেল, মা আমি অন্যায় করেছি। আমি পাপ করেছি। মাগো, ও আমায় কথা দিয়েছিল বিয়ে করবে। আমার এই অবস্থায় আজ ও আমায় চিনতেও অস্বিকার করছে। আমার আর কোন পথ নেই।
কোন পথ নেই। বাবারও ছিল না। বাবা দেউলিয়া হয়েছিলেন। দিদি সর্বস্বান্ত হল। দুজনেই চলে গেল। একা একা। চুপিচুপি।
মা বদলে গেলেন। মেশিনের আওয়াজ আর কাউকে বিরক্ত করে না। আমাদের স্বপ্নের নীল আলো আর ঘরময় গড়িয়ে বেড়ায় না। আমি বড় হয়েছি। বাবা আর আমার কাছে আসেন না।
সে কত বছর আগেকার কথা। মাঝে সময়ের স্রোত বয়ে গেছে কত অসংখ্য ধারায়। পড়া শেষ করে চাকরি পেয়েছি। ওপর ওয়ালাদের খুশি করে তাড়াতাড়ি প্রমোশন পেয়েছি। ভাড়া বাড়ির পাট চুকিয়ে দিয়ে নতুন ফ্ল্যাট নিয়েছি।
আমার মা আগের মতন পুরোপুরি না হলেও অনেকটা স্বভাবিক হয়েছেন। আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে শোক ভুলেছেন অনেকটা। মা হয়ত ভয় পেয়েছিলেন, আমিও যদি বাবা, দিদির মতন চলে যাই। কিন্তু আমি যে মায়ের মতন।
আমাদের ঘরে আবার স্বপ্নের নীল আলো জ্বলে। মা মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে দিদির সঙ্গে, বাবার সঙ্গে কথা বলেন। আমি টের পাই পাশের ঘর থেকে।
আমার ফিরতে প্রায় রোজই অনেক রাত হয়। মা পশ্চিমের ব্যালকনিতে রোজ দাঁড়িয়ে থাকেন। আমার নিঃসঙ্গ মা। সারাদিনের জমানো কথা উজার করে দেন খাওয়ার টেবিলে। কিছু কানে ঢোকে, কিছু দু পাস দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি তখন ক্লান্ত। বুঝতে না দিয়ে হাসি। মা বুঝতে পেরে চুপ করে যান একসময়। আমাদের ছোট ফ্ল্যাট। পশ্চিমের সরু ব্যালকনি। আমার মায়ের ওটাই একমাত্র সম্বল।
শনিবার, অফিসের কাজ তাড়াতাড়ি সেরে সন্ধ্যার মুখে ফ্ল্যাটের সামনে রিক্সা থেকে নামলাম। শনিবার একটু তাড়াতাড়ি ফিরি। শনি-রবি দুটো দিনই যা মাকে কিছুটা সময় দিতে পারি। মা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নেই। একটু অবাকই হলাম। এমন হওয়ার কথা নয়। কোন সময় হয় না। শরীর খারাপ হল নাকি আবার। 
তাড়াতাড়ি সিঁড়ি টপকে উঠে এলাম চারতলায়। বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষণ। কোন সাড়া নেই। হঠাৎ আবার কি হল? ওষুধগুলোও ছাই নিয়মিত খাবেন না।
হাতল ঘুরিয়ে চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে চাপা অন্ধকার। চোখ সয়ে যেতে এগোলাম। ভেতরটা অসম্ভব রকম চুপচাপ। শান্ত।
আমার মায়ের ঘরের দরজা ভেজান। যাক তাহলে ঘুমিয়েছেন। একটু নিশ্চিন্ত হয়ে ফ্রিজ খুলে বেশ কিছুটা ঠান্ডা জল গলায় ঢেলে দিলাম। হালকা নীল আলো দরজার তলা দিয়ে বেড়িয়ে সামনের পাপষটায় লুটিয়ে পরেছে। সামান্য ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। আমি মাকে দেখলাম। 
আমার মায়ের পা আমার সামনে। মাটি থেকে প্রায় আড়াই ফুট উঁচুতে।
মা নেই, টেবিলে ছোট চিঠি। সেই এক কথা। ছোটকা, আমি খুব একা হয়ে পড়েছি রে। এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। আমার আর কোন পথ নেই। তার চেয়ে এই ভালো।
কোন পথ নেই! কোন পথ কি সত্যিই ছিল না! বাবার, দিদির, মার! চুপি চুপি চোরের মতন সবাই পালালো একে একে। রইলাম আমি। নিঃসঙ্গ। একা।
আমার তিন কামরার ছোট ফ্ল্যাট। পশ্চিমে এক ফালি সরু ব্যালকনি। আমার জীবনের সঞ্চয়।
ঘরে আর নীল আলো জ্বালাইনা আমি। মাঝে মাঝে মার সঙ্গে দেখা হয়। মা ভালো আছে। বাবার কাছে, দিদির কাছে। আমাকে একা ফেলে তিনজনে সুখেই আছে। একে একে পালিয়ে গিয়ে বেশ সংসার পেতেছে আবার।
আমি আজকাল তাড়াতাড়ি ফিরি। আমার পশ্চিমের ব্যালকনি। সূর্য ওখানে অস্ত যায়। পাখির দল ক্লান্ত সূর্যের দিকে উড়ে যায় দল বেঁধে। আমার ব্যালকনিতে আঁধার নামে। আমি সন্ধ্যার রাত্রি হওয়া দেখি।

Comments

Popular posts from this blog

ছুটি

প্রতিশোধ

পরশ পাথর