আমায় মার্জনা করবেন



বিনয়ী লোকটাকে অনুপমের ভাল লাগল। হাত জোর করে বার বার বেফাঁস কথা বলার পর মার্জনা চাওয়ার ভঙ্গিটাও বেশ বিচিত্র। হাত দুটো সামনে জোড় করে কয়েকবার একটু কাঁপিয়ে দরাজ গলায় মাথা নত করে বেশ বলেন, - আমাকে মার্জনাকরবেন। এই যেমন একটু আগে ভোরের হালকা আলোয় সদ্য অবগাহন করে, বাসটা যখন চা পানের বিরতির জন্য দাঁড়িয়েছিল মালদা টাউনের কাছে একটা দোকানে। চায়ের দোকানটি যে তেমন ভাল নয়, সেটা জানিয়ে দিয়েই সেই হাত জোড়। - আমাকে মার্জনা করবেন। আপনি নতুন আসছেন এই পথে, আমি আজ দশ বছর... হেঁ হেঁ।
সত্যিই অনুপম এই প্রথম রাতের বাসে রায়গঞ্জ যাচ্ছে। যদিও বছরে অন্তত তিন চার বার তাকে রায়গঞ্জ যেতে হয় অফিসের কাজে। প্রত্যেকবার সে ট্রেনেই আসে। এবার ট্রেনের টিকিট না পাওয়াতে বাসের উপরই ভরসা করতে হয়েছে। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল এবারের যাত্রাটা বেশ একঘেঁয়ে হতে চলেছে। অন্যবার শেখর আসে তার সাথে, এবারে সেও বাইরে গেছে অন্য কাজে। কাজেই গোটা একটা রাতের বাস যাত্রা সম্বন্ধে একটু নাক সিঁটকোন ভাব ছিল অনুপমের।
অন্যান্য অভস্থ্য যাত্রিরা বাস ছাড়তেই দিব্যি নাক ডাকতে শুরু করল। বোকা বোকা মুখে এদিক ওদিক দেখছিল অনুপম। এরা পারেও বাবা! যদিও ট্রেনও প্রায় একই দৃশ্য দেখা যায়, তাও নিজে টান টান হয়ে শুয়ে পড়লে সেটা ক্রমশ গা-সওয়া হয়ে যায়।
রাতের রকেট বাস, বেশ জোরেই ছোটা শুরু করেছে। বাস ছাড়ার মিনিট ত্রিশের মধ্যেই বারাসাত পৌছে গেল। সেখান থেকেই এই ভদ্রলোকের যাত্রা আরম্ভ। ভাগ্যক্রমে অনুপমের পাশের ফাঁকা সিটটিতেই এঁর স্থান হল।
পাশে বসেই ভদ্রলোক তার দিকে বার কয়েক চোখ পিট-পিট করে তাকিয়ে বললেন, - কতদূর যাচ্ছেন স্যার?
গায়ে পড়া মানুষ অনুপম মোটেই পছন্দ করে না।একটু বিরক্ত হয়েই লোকটার দিকে ভালো করে না তাকিয়ে সে বলেছিল, - রায়গঞ্জ।
- যা সব হয়েছে। সব যেখানে জায়গা পাবে আগে নাক ডেকে নেবে। হুঁ...। কতকটা যেন নিজের মনেই বললেন ভদ্রলোক। - আপনি বোধহয় নাক ডাকেন না, তাইনা?
- কেন বলুন তো? বিরক্তি ক্রমশ বাড়ছিল অনুপমের। এতো ভালো জ্বালা হল! একে তো এই শোরগোল, তার উপর যদি এই অতি-আলাপী লোকটিকে সামলাতে হয়, তাহলে সত্যি সে পাগল হয়ে যাবে! মুখ ঘুরিয়ে জানলার বাইরে অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করল সে।
- কিচ্ছু দেখা যাবে না, বেকার চেষ্টা করছেন। সব কালো কালো, ভুতের মতন।
এবার মাথাটা গরম হয়ে গেল অনুপমের। এক ঝটকায় মুখটা ঘুরিয়ে সে বলল, - তাতে আপনার কি? আমি অন্ধকারই দেখব। আপনার অসুবিধা আছে?
- না স্যার! আমার কিসের অসুবিধা। আপনার চোখে চাপ পরবে, মানুষের চোখ তো, সব সইতে পারে না। তাই বলছিলাম। আমার কি! আর তাছাড়া কিছুই যখন দেখা যাবে না তখন বোকার মতন অন্ধকার হাতড়ে তো কোন লাভ নেই, তাইনা?
আচ্ছা মুশকিল হল তো। মাথা তুলে বাসের হেল্পার কাউকে দেখা যায় কি না খুঁজতে চাইল অনুপম। বাসের ভিতরটাও প্রায় অন্ধকার। টিম-টিম করে গোটা তিনেক নাইট ল্যাম্প জ্বলছে কেবল।
- সহকারী মশাই কে খুঁজছেন স্যার? তাকে পাবেন কোথায়! তিনি এতক্ষণে ড্রাইভারের পাশে ঘুম দিয়েছেন।
মনে মনে একটু ইতর জাতীয় গালাগালি দিয়ে অনুপম আবার অন্ধকারে মনোনিবেশ করল।
বাইরের নীকশ কালো অন্ধকার আর বাসের দুলুনিতেই বোধহয়, অনুপমের চোখ লেগে গিয়েছিল। সময় কত পার হয়েছে কে জানে! পাশের লোকটির হাতের ঠেলায় ধরফরিয়ে সোজা হল অনুপম। আর তখনই প্রথম শুনেছিল সেই কথাটা।
- আমায় মার্জনা করবেন। গাড়ি তো বহরমপুর এসে গেল। তাই বলছিলাম, মানে আপনি যদি কিছু খেতে চান। অন্তত ছোট বাথরুমের দরকার যদি পড়ে। তাই মানে..., একটু গুঁতো দিতে বাধ্য হলাম। আমায় মার্জনা করবেন।
এবার রাগের বদলে হাসি পেল অনুপমের। লোকটা তার উপকারই করতে চাইছে, অথচ সংকোচে নিজের ভিতরে নিজেই যেন ঢুকে যাচ্ছে। মাজা পেল অনুপম। একটু ঘুম হওয়াতে মেজাজটাও হালকা হয়ে এসেছে। আশেপাশের নাক ডাকার আওয়াজগুলোও প্রায় সব বন্ধ হয়ে গেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে অনুপম দেখল, সবাই প্রস্তুত হয়ে রয়েছে বাস থামার অপেক্ষায়।
বদ্ধ বাস থেকে নামতেই একরাশ শীতল হাওয়া অনুপমের সারা শরীরে খেলা করে গেল। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে একটা স্বস্থির আওয়াজ বেরিয়ে এল।
- আমায় মার্জনা করবেন।
সেই ভদ্রলোকের কথায় পিছন ফিরে চাইল অনুপম।
- কেন বলুন তো?
- না আপনি দিব্য ঘুমাচ্ছিলেন, আমি আপনাকে খোঁচা দিয়ে, মানে! .....
- আরে না না ঠিক আছে, আপনি তো আমার ভালোর জন্যই ডাকলেন।
এবার ভদ্রলোক স্বাভাবিক হয়ে এলেন। অনুপমের একটা হাত ধরে একটু ঝাঁকিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, - এই হচ্ছে কথা! কাউকে এটাই বোঝাতে পারি না জানেন! ভালোর জন্যেই করি। ভালোর জন্যেই বলি। তা সবাই উল্টো বোঝে। এই শুরুতে আপনিও যেমন ...... এঃ হেঃ! আমায় মার্জনা করবেন। কথাটা বললাম বলে।
এবার আর না হেসে পারল না অনুপম। লোকটার কথাগুলো বেশ উপভোগ্য। একটু গ্রাম্য কায়দায় শহুরে ভাব মিশিয়ে সে কথা বলার চেষ্টা করে।
- চা খাবেন? জানতে চাইল অনুপম।
- তা এই মাঝরাতে চা হলে একটু মন্দ হয় না, কি বলেন! আপনার স্যার অন্য প্রয়োজন থাকলে তাও সেরে আসতে পারেন। বাস এখানে প্রায় মিনিট ত্রিশেক দাঁড়াবে। মানে যদি আপনার বড় ছোট কোন বাথরুমের দরকার থাকে..... আমায় মার্জনা করবেন।
- না সেরকম কোন দরকার আমার নেই। হাসতে হাসতে বলল অনুপম।
- ওরকম মনে হয় স্যার। একটু পরেই দেখবেন বেগ আসছে। আমারও হয় স্যার। আমিও তো ঘুরে এলাম। একবার ঘুরেই আসুন না, আরও হালকা লাগবে। বড় না হোক অন্তত ছোট....... আমায় মার্জনা করবেন।
- আচ্ছা বেশ আমি ঘুরে আসছি! আপনি চা-য়ের ব্যবস্থাটা দেখুন ততক্ষণ।
আধা ময়লা বাথরুমটাতে ঢুকেই অনুপমের মাথা ঘুরে গেল। বড্ড ভুল হয়ে গেছে তো! বাসে; তার সীটের নীচে ব্যাগটা রয়েছে। উপরের তাকেও একটা ফোলিও রয়েছে। লোকটার যদি সেদিকে নজর থাকে? সেগুলো সরানোর উদ্দ্যেশে-ই যদি তাকে বাথরুমে পাঠানোর এত আগ্রহ থেকে থাকে? বাথরুম মাথায় উঠল অনুপমের। চটজলদি সেখান থেকে প্রায় ছুটে বেড়িয়ে এল সে।
বড় রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট মাঠ মতন জায়গায় বাসটা দাঁড়িয়ে। পাশে গোটা পাঁচেক খাওয়ার দোকান পাশাপাশি। একের পর এক গাড়ি ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। এই সব হোটেলগুলোতে যারা আসে তাদের জন্য সার দিয়ে বাথরুমের ব্যবস্থা থাকে হোটেলগুলোর ভিতরে। ড্রাইভারদের সাথে এদের যোগাযোগ থাকে, গাড়ি নিয়ে এলে তারা বোধহয় আলাদা কোন সুযোগ পেয়ে থাকতে পারে। প্রায় ছুটেই বাইরে এল অনুপম। বাসটা যায়নি, আছে এখনও। সাময়িক স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল সে। কিন্তু সেই লোকটা কোথায়? তাকে আর দেখা গেল না। বাসে উঠে লাগেজগুলো দেখবে কিনা ভাবছে অনুপম, এমন সময় গলাটা পেল সে, - হয়ে গেল? কি বলেছিলাম, দাঁড়ালেই হবে! হল তো!
- হ্যাঁ! একটু লজ্জিত মুখেই বলল অনুপম। ছিঃ ছিঃ! কি সব উল্টো-পাল্টা ভাবছিল সে।
রাতের বুক চিরে বাস আবার চলতে শুরু করেছে অনেকক্ষণ। নিজের ভাবনার জন্য অনুপম একটু যেন মন খারাপ করেই বসেছিল। কাউকেই আজ আর আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। শুধু বাজে ধারনাটাই আগে মনে আসে, আর সেটাকেই আমরা ধরে রাখতে ভালবাসি। অথচ লোকটা যে তার উপকারই করল, সেটা বুঝতে পারলেও নিজেকে হারতে দিতে চাই না। আমিই জিতব, এই মনোভাবেই সব শেষ হতে চলল।
- ঘুমালেন? পাশের ভদ্রলোকের ডাকে চটক ভাঙল অনুপমের।
- না! বলুন!
- আমায় মার্জনা করবেন। বিরক্তি করলুম।
- না! ঠিক আছে, বলুন!
- রায়গঞ্জ, কি কাজে চললেন? না অন্য কোন ব্যপার?
- অফিসের কাজে। আপনি কতদূর?
- আমি যাব ইঁটাহার। রায়গঞ্জের কিছুটা আগে।
- কাজে?
- কাজ! ভদ্রলোক কয়েক পলক তাকালেন অনুপমের দিকে। তারপর বললেন, - হ্যাঁ, তা কাজেই বলতে পারেন। আবার নাও বলতে পারেন।
- কেউ থাকেন না কি সেখানে?
এবার লোকটি যেন একটু লজ্জা পেলেন। লাজুক লাজুক গলায় বললেন, - আমার শ্বশুরবাড়ি।
- ও তাই বলুন। এবার মজা করল অনুপম। - শ্বশুরবাড়ি চলেছেন আপনি। তা প্রায়ই জান মনে হচ্ছে! রাস্তাঘাট প্রায় মুখস্ত আছে দেখছি!
- তা যাই! আজ প্রায় দশ বছর হল বিয়ে হয়েছে। ইয়ে এটি মানে আমার আবার দ্বিতীয় পক্ষ। মাঝে মাঝেই যেতে হয়। শ্বশুর মশাই বুড়ো হয়েছেন, শ্বাশুরি নেই। তাঁকে দেখাশুনা করতে মাঝে মাঝেই ছুটতে হয়। কিছু জমি জমাও রয়েছে সেখানে, তাদেরও দেখাশুনা লাগে। বউ বছরের মধ্যে ধরুন গে প্রায় পাঁচ সাত মাস ওখানেই থাকে।
- বুঝলাম। আলতো করে হাই তুলল অনুপম। রাত প্রায় শেষের দিকে। ঘড়ি বলছে তিনটে চল্লিশ। এবার একটু চোখ না বুঝলে চলবে না। কাল রায়গঞ্জ পৌছেই আবার মিটিং আছে সকাল ১১টায়। বিকালে আবার একটা।
- এবার যে একটু চোখ বূজতে হয় দাদা। কাল অনেক কাজ। আবার একটা হাই তুলে বলল অনুপম।
- আমায় মার্জনা করবেন। আপনি হেলান দিয়ে একটু ঝিমিয়ে নিন, আমি জেগে রইলাম।
- হুঁ! বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে ঘাড় কাত করে দিল অনুপম।
মালদা ছাড়িয়ে বাস ক্রমশ চলেছে রায়গঞ্জ এর দিকে। ঠিক মতন গেলে আর ঘন্টা দু-আড়াই। সকালের হালকা রোদ বাসের জালনা দিয়ে ঢুকে যেন ভিজিয়ে দিচ্ছে অনুপমকে। সকাল তার কাছে খুব প্রিয়। কলকাতার আকাশে এই রকম মুক্ত সকাল, এমন বাঁধভাঙ্গা কাঁচা রোদ দেখার সৌভাগ্য সেভাবে হয় না। প্রাণ ভরে সে বাতাস টানছিল নিজের মধ্যে। রাত জাগার ফলে চোখদুটো একটু জ্বালা জ্বালা করছিল, তাও সে দু-চোখ ভরে বাইরের দৃশ্য দেখছিল। তার কাল রাতের সহযাত্রীটি এখনও জেগে বসে রয়েছেন পাশে। লোকটা কি সারারাত একবারও চোখ বোজেনি? আড়চোখে একবার তাকালো অনুপম। রাতের অধো আলো আধো অন্ধকারে ভাল বোঝা না গেলেও এখন স্পস্ট দেখা যাচ্ছে লোকটাকে। বছর পঞ্চাশ বয়েস। রোগা রোগা চেহারা। পরনের জামা-প্যান্ট খুব একটা পরিষ্কার নয়, তবে দাড়ি-গোঁফটি কামানো পরিপাটি করে। মাথা নীচু করে চুপ করে বসে রয়েছেন এখন। সারা রাতের যাত্রার একটা ধকল তো আছেই। যতই ডেইলি প্যাসেঞ্জারী করুক না কেন!
- আপনার ইঁটাহার তো প্রায় চলে এল। নীরবতা ভেঙে বলল অনুপম।
- হ্যাঁ স্যার! ইঁটাহার থেকে রায়গঞ্জ আর আধঘন্টা চল্লিশ মিনিট।
- আপনার নামটা কিন্তু জানা হয়নি। একটু লজ্জিত কন্ঠে বলল অনুপম।
- নামটা বড় কথা নয়, এই যে এক সাথে এতটা পথ সুখ দুঃখ ভাগ করতে করতে এলাম, সেটাই বড় কথা স্যার।
- হু তাও!
- অধমের নাম বিশ্বরূপ ভুইঞা।
- ও! কি করেন আপনি?
- কি করি? ভদ্রলোক এবার যেন বেশ চিন্তায় পড়লেন। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, - এই বাড়ি ঘর দেখি, তখন বললাম না! শ্বশুর মশাইয়ের কিছু জমি জমা আছে, সে সব দেখভাল করতে হয়। এই আর কি!
ও! ঘরজামাই। মনে মনে বলল অনুপম। শ্বশুরকে তেল দিতে দিতেই বোধহয় স্বভাবটা এমন মার্জিত হয়ে গেছে। বাপ মা নামটাও বেশ রেখেছে, বিশ্বরূপ। মনে মনে হাসল অনুপম।
- না না ঠিক ঘর জামাই ভাববেন না যেন! অনুপমের মনের কথাটা বুঝেই যেন বললেন বিশ্বরূপ। বারাসাতে আমি ভ্যান চালাই নিয়মিত। নিজস্ব গাড়ি, রোজগার মন্দ হয় না। চলে যায় আরকি!
- তবে আজ শ্বশুরবাড়ি কি বউকে বাড়ি আনতে? না জমি তদারক করতে? মজা করে জিজ্ঞেস করল অনুপম।
- হ্যাঁ! তদারক করতে। ঠিকই ধরেছেন। তদারক করতে। এটাই ঠিক কথা। ঠিক কি করতে আজ যাচ্ছি, সেটা কে ঠিক কি বলব, সেই কাল থেকে চিন্তা করছি, জানেন! ওঃ! আপনি ধরিয়ে দিলেন। তবে! সবার কাছেই শেখার আছে। কেউ ফেলনা নয়।
লোকটা পাগল নাকি! অনুপম অবাক চোখে তাকালো একবার। কথাগুলো মাঝে মাঝে কেমন যেন মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। যাকগে্, আর তো কিছুক্ষণ। চোখটা বুজল অনুপম। জ্বালা জ্বালা ভাবটা যদি একটু কমে।
ইঁটাহার পৌছতে বাসটা প্রায় আধঘন্টা লেট করল। বেশ কড়া রোদ উঠে গেছে তখন। মুখের উপর রুমাল চাপা দিয়ে এলিয়ে ছিল অনুপম। বাসটা দাঁড়াতেই বিশ্বরূপ সেই পরিচিত ঢঙে একটি আলতো খোঁচা দিল।
- হু! মাথাটা তুলে সোজা হল অনুপম। - এসে গেছে আপনার জায়গা?
- হ্যাঁ স্যার। এবার নামতে হয়। কাল সারারাত অনেক জ্বালালুম। আমায় মার্জনা করবেন।
- আরে না না! সময়টা তো বেশ কেটে গেল আপনার সাথে। কপট বিনয় দেখিয়ে বলল অনুপম। এই লোকটার পাগলামো থেকে বাঁচতেই যে সে এতক্ষণ রুমাল চাপা দিয়ে মুখ লুকিয়ে রেখেছিল সেটা চেপে গেল অনুপম।
- চলি তবে। আলতো হাতে সীটের হ্যান্ডেলে চাপ দিয়ে উঠে দাড়ালেন বিশ্বরূপ। একটু যেন টলে গেল তার পা। সামলে নিয়ে এগিয়ে গেলেন দড়জার দিকে। তার হাঁটার ভঙ্গি দেখে অনুপমের মনে হল, এ লোক নিশ্চই একটু পাগলাটে। না হয়ে যায় না। কাল সারারাত দিব্যি সুস্থ স্বাভাবিক ছিল, এখন আবার টলতে লেগেছে। মাথায় অবশ্যই কিছু প্যাচ ঢিলা আছে।
বাইরে বেরিয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়াল বিশ্বরূপ। - আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার সাথে সময় কাটিয়ে মনটাও অনেক হালকা হয়েছে। কিছু ভুল হলে আমায় মার্জনা করবেন।
এবার আর সামলাতে না পেরে উচ্চ কন্ঠে হেসে উঠল অনুপম। - আপনার এই মার্জনা চাওয়ার ধরনটা খুব সুন্দর। সারারাত কতবার মার্জনা চেয়েছেন গুনেছেন কি? যান যান বউ নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। আচ্ছা আপনার শ্বশুর মশাইয়ের সামনেও কি এমন বার বার মার্জনা চান? হেসেই চলল অনুপম।
- হ্যাঁ। সবার কাছে চাই। বউ নিয়ে বাড়ি যাব বলেই তো এলুম স্যার। একটা কাজ সেরেই ফিরে যাব।
- ওঃ হ্যাঁ! জমির তদারক। আবার উচ্চ কন্ঠে হাসল অনুপম।
- হ্যাঁ! তদারক; তদারক। মুখটা ম্লান হয়ে এল বিশ্বরূপের। আমার ছোট শালা এই বাসে রায়গঞ্জ যাচ্ছে। কোন দরকার থাকলে তাকে বললেন স্যার। কথাটা বলে বিশ্বরূপ হাঁক দিল, - বুদ্ধু! ও বুদ্ধু! এই স্যারের সীটের কাছে আয় না!
বাসটা ছেড়ে দিল। বিশ্বরূপ ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে বাসস্ট্যান্ড। মাথা ঘুরিয়ে দেখল অনুপম। বুদ্ধু নামের ছেলেটি পাশে এসে বসেছে। হাসতে হাসতে তাকে অনুপম বলল, - কিছু মনে করবেন না, আপনার জামাইবাবু কি একটু .......
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বুদ্ধু বলল, - মাথাটা কি আর ঠিক থাকে দাদা! যার জোয়ান ছেলে গত সন্ধ্যায় ডেঙ্গুতে মরে হাসপাতালে কাঠ হয়ে আছে, তার মাথার দোষ কোথায়? ওর কোন কথা ধরবেন না।
মুখটা হাঁ হয়ে রইল অনুপমের। মুখের কথা যেন মুখেই আটকে গেল। গলার কাছে কি যেন দলা পাকিয়ে উঠতে লাগল। মনে মনে শুধু সে বলল, - আমায় মার্জনা করবেন।

Comments

Popular posts from this blog

ছুটি

প্রতিশোধ

পরশ পাথর