হারানো প্রাপ্তি



ওরা তিনজন যখন অটো থেকে থানার সামনে নামল তখনও টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। একেই অমাবস্যার রাত তার উপর আকাশের ঘন মেঘের জন্য চারিদিক যেন আরও নিকষ কালো আবরণে ঢাকা পড়েছে। পল্টু আর গনেশ নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল। একহাত দূরের মানুষও যেন ঠিক মতন ঠাওর হয় না। বৃষ্টির জন্যই বোধহয় রাস্তার আলোগুলোও আজ জ্বলছে না। অটোটা চলে যেতে একপাশে সরে এসে পল্টু বলল, ‘যেতেই হবে! হ্যাঁ রে!’
গনেশ আশপাশটা নজর বোলাচ্ছিল, এবার মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ! ভয় পাচ্ছিস কেন?’
পল্টু পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে একটা ধরাল।
‘তোর হাত কাঁপছে কেন? সহজ হ!’ থানার সামনের ঘরটার দিকে দূর থেকে উঁকি দিয়ে বলল গনেশ।
‘না না ভয় কি?’ নিজের মনে মাথা নেড়েই বলল পল্টু।
‘চল এবার ভেতরে যাই।’ গনেশ বলল পল্টুর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে।
‘আঃ আঃ আচ্ছা! আমাদের কেউ রেললাইনের ধারে দেখে ফেলে নি তো?’ পা বাড়িয়েও দু পা পিছিয়ে এল পল্টু।
‘ধ্যুর! কি যে বলিস! রাতটা কেমন অন্ধকার দেখছিস না! আর যা বৃষ্টিটা হল, কেউ দেখতেই পারে না। তুই মাইরি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছিস। আর আমাকেও পাইয়ে দিচ্ছিস।’
‘কি বলবি গিয়ে?’ আধ খাওয়া সিগারেটটা গনেশের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল পল্টু।
‘যা ঠিক করেছি তাই! তোকে বললাম না আগে। বলব তিনজন বন্ধু সিনেমা দেখে ফিরছিলাম। স্টেশনের কাছে রেল লাইন ধরে এলে একটু তাড়াতাড়ি হয়, অন্ধকারে ট্রেনটাকে ঠিক দেখতে পাইনি’।
‘মানবে?’ অবিশ্বাসের গলায় বলল পল্টু।
‘মানবে বে বাবা! তুই চাপ নিস না। তোর এই চাঁদপানা মুখ দেখলে আরও মানবে না। তোকে আনাই আমার উচিৎ হয় নি শালা!’
মাথা চুলকে পল্টু বলল, ‘তার চেয়ে এক কাজ কর গনেশ, বলবি আমরা কিছু জানি না। সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘যাই বলিনা কেন দুজনের কথা যেন দু রকম না হয় সেটা মনে রাখবি।’
‘হু!’ কিছুটা চিন্তিত মুখে বলল পল্টু।
‘তা হলে ফাইনাল বল, কি বলবি।’ বলল গনেশ।
‘আচ্ছা! আমাদের একসাথে তো কেউ দেখে নি, আমরা একসাথে ছিলাম তা কেউ জানে না।’
‘তুই দেখছি গোলাবি!’ রাগত স্বরে বলল গনেশ।
‘আমরা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম, তাই তো?’
‘হু, এটাই ফাইনাল। চল।’
গুটিগুটি পায়ে ওরা থানার ভিতরে এসে ঢুকল। তৃতীয়জন কোন কথাই বলে নি। সে নিঃশব্দে চলল ওদের পিছন পিছন।
এত রাতেও থানার ভিতরে বেশ ভীর। একপাশে পেতে রাখা নড়বড়ে বেঞ্চিটাতে আলতো করে বসল ওরা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার তাকালো।
পল্টু আমতা আমতা করে বলল, ‘একটা রিপোর্ট, মানে’ কথাটা সে শেষ করতে পারল না। গলাটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
লোকটা আপাদমস্তক ওদের দেখল বার কয়েক, তারপর পিঠটা টান করে বলল, ‘কিসের রিপোর্ট?’
পল্টু কষ্ট করে আবার মুখ খুলতে যাচ্ছিল, তার আগেরই তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গনেশ উত্তর দিল, ‘এ্যাকসিডেন্ট।’
লোকটা এবার নড়েচড়ে উঠল, ‘কোথায়?’
‘রেল লাইনে, মানে প্রতাপপুরের দিকে।’ গনেশের গলাটাও যেন এবার ইষৎ কেঁপে গেল।
‘রেলে কাটা!’ লোকটা তাচ্ছিল্যের সাথে বলল।
‘হু!’ পল্টু উত্তর দিল এবার।
‘ও! আপনারা দেখলেন?’
‘হ্যা, মানে, আমরা মানে…’ একটু জল পেলে যেন ভাল হত। পল্টু তাকাল গনেশের দিকে।
‘রেলে কাটা হলে এখানে হবে না, রেল পুলিশের কাছে যান।’
‘ও!’ গনেশ তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। এখান থেকে বেরোতে পারলে যেন ওরা বাঁচে।
থানা থেকে বেড়িয়ে ওরা মিনিট পাঁচের কোন কথা না বলে শুধু হাঁটতে থাকল।
জগন্নাথপুর চার মাথার মোড়ে এসে একটা চা-য়ের দোকানে ঢুকে এক নিঃশ্বাসে অনেকটা জল খেল পল্টু। তার পর চেয়ারে বসে পকেট হাতড়ে বিড়ির প্যকেটটা বের করে বলল, ‘কি দরকার গনেশ! চুপচাপ বাড়ি চলে যাই চল।’
‘গিয়ে?’ দাঁত-খিচিয়ে বলল গনেশ।
‘উত্তম আমাদের সাথে সব সময় থাকে সবাই সেটা জানে। আজ সকালেও বিপ্লবের দোকানে আড্ডা মেরেছি আমরা গোটা সকাল। সবাই এসে আগে আমাদের ধরবে।’
তৃতীয় ব্যক্তিটি এতক্ষণে কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। ওরা কি ভাববে কে জানে। চুপ থাকাই ভাল। একপাশের চেয়ারে বসে সে একদৃষ্টে দেখতে লাগল গনেশ আর পল্টুকে।
‘তাহলে রেল পুলিশের কাছেই যেতে হবে এবার।’ নিজের মনেই কথাটা বলল গনেশ।
পল্টু কোন উৎসাহই পাচ্ছেনা আর কথা বলার। সে জোরে জোরে বিড়িতে টান দিতে লাগল ঘন ঘন। আধঘন্টা কেটে গেল একইভাবে। মাঝে শুধু একবার চা খেল ওরা।
তৃতীয় ব্যক্তিটি এবার মুখ খুলল প্রথমে, ‘একটা কথা আমি বলি….. ’
‘কিছু বললি?’ গনেশ তাকাল পল্টুর দিকে।
পল্টু চা-য়ের গ্লাসটা নিয়ে আপন মনে নাড়াচাড়া করছিল, সে চকিতে একবার মুখ তুলে তাকাল, তারপর আবার মুখ নিচু করে বলল, ‘তুই যে কেন এটা করতে গেলি।’
‘তোর সায় ছিল না বুঝি?’ ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল গনেশ।
চেয়ার ছেড়ে উঠে গনেশ হাত মুঠো করে বলল, ‘যা থাকে বরাতে, চল! রেল এর থানাতেই যাব।’
ওরা আবার বেড়িয়ে পড়ল। প্রতাপপুর স্টেশন যাওয়ার একটা শর্টকাট রাস্তা আছে মাছ বাজারের পাশ দিয়ে। ওরা সেই পথটাই ধরল। অন্ধকার স্যাতস্যাতে গলি দিয়ে কোন মতে একজন যাওয়া যায়। ওরা আগে পরে করে এগোতে লাগল এক এক করে। একে এত রাত, তার উপর অমাবষ্যা। কোন কুকুর তেড়ে না এলেই হল। মোবাইল এর ক্ষীণ আলোয় গলিটা যেন আরও অন্ধকার লাগছে। পল্টু গনেশের জামাটা পিছন থেকে খাঁমচে ধরল।
‘আবার কি হল?’ গনেশ বিরক্তি নিয়ে বলল।
‘কি অন্ধকার মাইরি!’
‘ভয় পেলি নাকি?’ গনেশ এবার হেসে উঠল।
প্রতাপপুর এমনিতেই শুনশান একটা স্টেশন, এই মাঝ রাতে তা আরও যেন খাঁ খাঁ করছে। ওরা তিনজন জি.আর.পি –র সামনে এসে দাঁড়াল।
পরপর ঘটনার জেরে তিনজনই যেন একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পল্টু গনেশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি কাজ সেরে কেটে পড়ি চল।’
গনেশ স্টেশনের এমাথা থেকে ওমাথা একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘হু! পুরো ফাঁকা। লাস্ট ট্রেনটাও তো চলে গেছে ঘন্টাখানেক আগে।’
‘এখন গেলেই সন্দেহ করবে রে!’ চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল পল্টু।
‘তুই শুধু গুলিয়ে দিস পল্টু।’ গনেশ বিরক্তিতে হাত নাড়ল।
দুজন সাফাইওয়ালা বড় বড় ঝাড়ু নিয়ে প্ল্যাটফর্মটা ঝাট দিচ্ছে খচ্ খচ্ শব্দ তুলে। গোটা স্টেশনে আর কেউ জেগে আছে বলে মনে হয় না। রাতের অন্ধকারে খচ্ খচ্ শব্দটা যেন কয়েকগুণ বেড়ে চারদিকের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিচ্ছে।
হঠাৎ গনেশ পিছন ফিরে দাঁড়াল। কি মনে করে যেন দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে এল স্টেশন থেকে। বাকি দুজন একটু অবাক হয়ে কয়েক মুহুর্ত থমকে থেকে পিছু নিল গনেশের।
‘ফিরে এলি যে?’ পল্টু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।
‘ঠিকই বলেছিস। এত রাতে আমাদেরই চেপে ধরবে।’
গলির মুখটায় ফিরে এসে গনেশ চিন্তত মুখে এদিক ওদিক তাকাল। তারপর হেসে বলল, ‘ফিরে যাই চল। বাড়ি গিয়ে টেনে ঘুম দিই। তারপর, কাল সকালে দেখা যাবে।’
পল্টুর মুখেও এতক্ষণে হাসি ফিরে এসেছে।তার মাথা থেকে যেন একটা বোঝা নেমে গেল। সে বলল, ‘সেই ভাল! চল বাড়ি যাই।’
শর্টকাট গলিটা দিয়ে ওরা আবার ফিরে এল। থানার সামনে দিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল লেবেলক্রশিং এর দিকে। একবার আঁড়চোখে ভিতরে তাকিয়েছিল গনেশ। কেউ যেন লক্ষ না করে। না, কেউ নেই থানার সামনে।
‘এবার?’ প্রশ্ন করল পল্টু।
‘এবার কি?’ গনেশ মুখ ফিরিয়ে তাকাল।
‘কোন দিক দিয়ে যাবি?’ অন্ধকার রেল লাইটার দিকে তাকিয়ে বলল পল্টু।
‘মেন রোড দিয়ে গেলে অনেক সময় লাগবে।আর পুলিশের গাড়ি মাঝে মাঝে টহল দেয়, ওদের সামনে পড়লে আর এক লাফরা। লাইন ধরেই চলে যাই চল।’
‘লাইন!’ আঁতকে উঠল পল্টু।
‘তো কি হয়েছে। ওটা দিয়ে যাওয়াই সেফ। কেউ দেখতে পাবে না। ভয় খাস না তো ফালতুকা।’
ওরা অন্ধকার রেল লাইন টাই ধরল। পাশাপাশি দু’জোড়া লোহার পাত সোজা চলে গেছে সামনের দিকে। দুরে লাল লাল সিগন্যালগুলো যেন ওদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে বিস্ময়ে। কালো খোয়া পাথরের উপর দিয়ে ওরা আসতে আসতে এগিয়ে গেল গুপ্তিপাড়ার দিকে।
‘স্পটটা কোথায় রে?’ পল্টু গনেশের কাঁধে হাত রেখে বলল।
গনেশ ঠাহর করতে না পেরে বলল, ‘এখানেই হবে কোথাও।’
সবচেয়ে পিছনে আসছিল তৃতীয় ব্যক্তিটি। এতক্ষণ সে কোন কথাই বলে নি। এবার মুখ খুলল, ‘আর একটি এগিয়ে ডাউন লাইনের ধারে। ঐ সিগন্যালটার কাছে।’
গনেশ আর পল্টু সবিস্ময়ে মাথা ঘোরাল এবার। পল্টু এক লাফে গনেশের প্রায় ঘাড়ের কাছে উঠে পড়ল।
গনেশ প্রচন্ড ভয় পেয়ে বলল, ‘কে?’
অন্ধকারে তৃতীয় ব্যক্তিটি এবার আরও একটু এগিয়ে এল কাছে।
‘উত্তম রে! চিনতে পারছিস না?’
ভয়ে, বিস্ময়ে, ঘটনার আকস্মিকতায় পল্টু আর গনেশ প্রায় একসাথেই রেল লাইনের উপর পড়ে গেল।
মাথাটা ঝুকিয়ে ওদের মুখের কাছে এল উত্তম, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওভাবে আমাকে না মারলেও পারতিস। যার কথায় এতদিনের বন্ধুকে এভাবে শেষ করে দিলি সে কিন্তু দিব্যি বাড়িতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। মাঝখান থেকে দেখ তোদের যত অশান্তি। কেউ ওকে ধরতে পারবে না। তোরা শুধুশুধু …………’
উত্তমের গলা যেন আস্তে আস্তে দুরে চলে গেল। শরীরটা মিশে গেল অমাবষ্যার কালো অন্ধকারে।
সকাল থেকে প্রতাপপুর থানায় বেশ ভিড়। তিনটি পরিবারের লোক জমায়েত হয়েছে। সাথে পাড়ারও বেশ কিছু কৌতুহলী মানুষের জটলা। স্থানিয় কাউন্সিলার নিজে ছুটে এসেছেন তদারকি করতে। গনেশ পল্টু তাদের পার্টির এ্যাকটিভ মেম্বার। এর একটা বিহিত চাই।
খবরটা ভোরে হতেই থানায় চলে এসেছিল। গুপ্তিপাড়ার দিকে রেলে কাঁটা পড়ে মারা গেছে দুজন। চেহারা প্রায় চেনাই যায় না। মুখের তেমন কোন ক্ষত না হলেও, দুজনেরই চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে আতঙ্কে। লেবেলক্রশিং থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দুরে ওরা কি করছিল সেটাই বড় প্রশ্ন।পল্টু আর গনেশের বাড়ির লোক তদন্তের দাবীতে এঘর ওঘর করতে লেগেছে সকাল থেকে।
তৃতীয় পরিবারের লোকজন অবশ্য কিছুটা শান্ত। তারা এসেছে উত্তমের হারানো প্রাপ্তির জন্য ডাইরি করতে।
না উত্তমের লাশ কোথাও পাওয়া যায় নি।

Comments

Popular posts from this blog

ছুটি

প্রতিশোধ

পরশ পাথর